ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলেও ক্যানসারে আক্রান্ত অনেক রোগীই মাঝপথে তা থামিয়ে দেন। চিকিৎসার খরচ বহন করতে না-পেরেই যে এমনটা হচ্ছে, তা কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নিয়মিত ভাবে শহরের হাসপাতালে যাতায়াতের খরচ বহন করার সামর্থ্য থাকে না ওই সমস্ত রোগী এবং তাঁদের পরিজনদের। যদিও বছর ছয়েক আগে রাজ্য পরিবহণ দফতর নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছিল, ক্যানসার বা থ্যালাসেমিয়ার মতো মারণ রোগে আক্রান্তেরা বিনামূল্যে সরকারি পরিবহণ ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু সেই নির্দেশিকার কথা কি রোগী বা চিকিৎসকেরাও সকলে জানেন?
শহরের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আসা ক্যানসার আক্রান্তদের দাবি, তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহালই নন। একই দাবি ক্যানসার চিকিৎসকদের বড় অংশেরও। বরং চিকিৎসক এবং ক্যানসার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলি জানাচ্ছে, ক্যানসারের চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনার নেপথ্যে একটি বড় কারণ, যাতায়াতের খরচ বহন করতে না পারা। শহর ও জেলা সদরের যে সমস্ত সরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসা হয়, সেখানে কোথাও এই সংক্রান্ত নির্দেশিকা চোখে পড়ে না।
সূত্রের খবর, আগে ক্যানসার রোগীদের প্রায় ৬০ শতাংশ মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতেন। এখন কিছুটা কমেও পরিসংখ্যান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশে। যার মধ্যে বয়স্কদের পাশাপাশি শিশু রোগীরাও আছে। শিশুদের চিকিৎসা যাতে মাঝপথে বন্ধ না হয়, এবং তাদের চিকিৎসা-সহ সামাজিক সহযোগিতা করতে শহরের তিনটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ‘সহায়তা ডেস্ক’ চালু করেছে শিশুদের ক্যানসার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘লাইফ বিয়ন্ড ক্যানসার’। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চেয়ারম্যান পার্থ সরকার জানালেন, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পরিষেবা দিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, যত সংখ্যক শিশু রোগী প্রথমে চিকিৎসা করাতে আসছে, ফলো-আপের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা অনেকটাই কমে যাচ্ছে। যার মূল কারণ, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে আসা-যাওয়ার খরচ জোগাতে পারছে না শিশুর পরিবার। পার্থ বলেন, ‘‘আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করে রোগীদের ফলো-আপে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি। পরিবহণ দফতর ও স্বাস্থ্য দফতর যদি বিনামূল্যে যাতায়াতের বিষয়টি আরও বেশি করে প্রচার করে, তা হলে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধের প্রবণতা কমবে।’’
রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে বেসরকারি হাসপাতালেও ক্যানসারের চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন বহু দরিদ্র মানুষ। কিন্তু সমস্যা দেখা দিচ্ছে যাতায়াত এবং থাকার খরচে। বহু পরিবারই দৈনিক রোজগারের উপরে নির্ভরশীল। যে দিন তারা জেলা থেকে শহরে চিকিৎসার জন্য আসছেন, সে দিন কোনও রোজগার হচ্ছে না। চিকিৎসা বিনামূল্যে মিললেও যাতায়াতে অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে। যা দিনের পর দিন বহন করা বহু রোগীর পক্ষেই সম্ভব নয়।
ক্যানসার রোগীদের বিনামূল্যে যাতায়াতের বিষয়টি যেমন অধিকাংশের অজানা, তেমনই তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও কার্ডও নেই। সিনিয়র ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ক্যানসার রোগীরা একা হাসপাতালে আসতে পারেন না। তাঁদের সঙ্গে আসা এক জনের ভাড়া যদি কিছুটা মকুব করা হয়, তা হলে খুবই উপকার হবে। এই সব কিছুরই মূল লক্ষ্য, যেন মাঝপথে কারও চিকিৎসা বন্ধ না হয়।’’
২০১৯ সালে পরিবহণ দফতর যে নির্দেশিকা জারি করেছিল, তা কি খাতায়-কলমেই থেকে যাবে? যদি তা না হয়, তা হলে প্রচার কোথায়? কেন স্বাস্থ্যসাথী কিংবা অন্য প্রকল্পের মতো এটাও প্রচারে আসে না? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘বিষয়টি কী
ভাবে আরও বেশি মাত্রায় প্রচার করা যায়, দেখা হচ্ছে।’’ নির্দেশিকা থাকলেও তা যে অনেকের অজানা, সে কথা মানছেন পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীও। তাঁর কথায়, ‘‘নির্দেশিকা এখনও রয়েছে। পরিবহণ নিগমগুলিকে আবারও বলব, ক্যানসার রোগীরা উপযুক্ত নথি দেখালে তাঁদের বিনামূল্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে। এই সম্পর্কে প্রচার কী ভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছি।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)