Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ঠান্ডা কর মাথা, বলেই ছাড় কেষ্টকে

স্রেফ মাথা ঠান্ডা রাখার পরামর্শ দিয়ে কার্যত আরও এক বার অনুব্রত মণ্ডলের পাশেই দাঁড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পুলিশকে বোম মারা’র হুমকি দেওয়ার পরেও অনুব্রতর শরীরে অক্সিজেনের অভাবের কথা বলে ‘মানবিক’ অবস্থান নিয়েছিলেন নেত্রী। আর এখন যখন মাখড়া-কাণ্ডের নেপথ্য নায়ক হিসেবে উঠে আসছে বীরভূম জেলা সভাপতির নাম, তখন তাঁকে নবান্নে ডেকে পাঠিয়ে মমতা ‘মাথা ঠান্ডা’ করতে বলেছেন বলে অনুব্রতর দাবি।

 ঢুকছেন নবান্নে।—নিজস্ব চিত্র

ঢুকছেন নবান্নে।—নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৩
Share: Save:

স্রেফ মাথা ঠান্ডা রাখার পরামর্শ দিয়ে কার্যত আরও এক বার অনুব্রত মণ্ডলের পাশেই দাঁড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পুলিশকে বোম মারা’র হুমকি দেওয়ার পরেও অনুব্রতর শরীরে অক্সিজেনের অভাবের কথা বলে ‘মানবিক’ অবস্থান নিয়েছিলেন নেত্রী। আর এখন যখন মাখড়া-কাণ্ডের নেপথ্য নায়ক হিসেবে উঠে আসছে বীরভূম জেলা সভাপতির নাম, তখন তাঁকে নবান্নে ডেকে পাঠিয়ে মমতা ‘মাথা ঠান্ডা’ করতে বলেছেন বলে অনুব্রতর দাবি।

বুধবার মমতার সঙ্গে বৈঠক শেষে অনুব্রত বলেন, “নেত্রী আমাকে বলেছেন, কেষ্ট মাথা ঠান্ডা কর। মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার কর। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে দলটা কর।”

দলের অন্য একটি সূত্র অবশ্য দাবি করছে, ‘মেন্টর’ মুকুল রায়ের সামনেই মাখড়ার ঘটনা নিয়ে অনুব্রতকে এ দিন যথেষ্ট কড়া কথা শুনিয়েছেন মমতা। অনুব্রত তখন ওই ঘটনার যাবতীয় দায় ইলামবাজারের নেতা জাফারুল ইসলামের উপর চাপিয়ে দেন। মমতা জানান, জাফারুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি। কিন্তু অনুব্রত যে ছাড় পাচ্ছেন, সেটা স্পষ্ট। ভাঙড়-কাণ্ডে পুলিশ কোনও পদক্ষেপ না করলেও দলীয় স্তরে অন্তত মৌখিক ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে। অনুব্রতর ক্ষেত্রে সেটুকুও হচ্ছে না।

তবে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠরা একে একে দলের রোষে পড়ছেন। ক’দিন আগে জেলা যুব সভাপতির পদ থেকে বাদ গিয়েছেন অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ নেতা সুদীপ্ত ঘোষ। মদ্যপ অবস্থায় বোলপুর থানায় ঢুকে মারধর-ভাঙচুর চালানোর ঘটনায় অভিযুক্ত এই সুদীপ্ত অনুব্রতর বরাভয়েই এলাকায় দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। পুলিশ তাঁকে ধরার সাহস পায়নি। মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলে নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পরে সুদীপ্তকে ছেঁটে ফেলেন। এর মধ্য দিয়ে অনুব্রতকেও দল পরোক্ষে বার্তা দিল কি না, সে প্রশ্ন তখনই উঠেছিল। তার মধ্যেই মাখড়ার ঘটনা ঘটে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

তৃণমূল সূত্রে খবর, মাখড়া-কাণ্ডে অসন্তুষ্ট মমতা ঘটনার পরপরই তিনি অনুব্রতকে ডেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। বার্তা পাঠান, অনুব্রত যেন কথা কম বলেন। দলের অনেক নেতা বলছেন, এক দিকে বিজেপির উত্থান ও অন্য দিকে দলীয় ভাবমূর্তিতে উত্তরোত্তর কালির দাগ মমতার কপালে ভাঁজ ফেলেছে। তাই এ দিন অনুব্রতকে তলব ও জাফারুলের উপরে কোপ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া।

এ দিন বিকেল সওয়া চারটে নাগাদ নবান্নে পৌঁছন অনুব্রত। মুকুল রায়ের সঙ্গে বেরিয়ে যান প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে। নবান্ন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাইরে তাঁকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। মুকুলের সঙ্গে আলোচনার শেষ দিকে মমতা তাঁর স্নেহভাজন কেষ্টকে ডেকে নিয়ে যা বলার বলেন। যদিও অনুব্রত পরে দাবি করেন, “আগামী ২৮ নভেম্বর দুর্গাপুরে চার জেলার কর্মীদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সভা করবেন। সে সব নিয়েই আলোচনা হয়েছে।” পাড়ুই নিয়ে কোনও কথা হয়নি? কেষ্টর জবাব, “মুখ্যমন্ত্রী সব খবরই রাখেন। তাঁকে জানিয়েছি, জেলার ১৬৭টি অঞ্চলের ৩৩০০ গ্রামের মধ্যে মাত্র সাতটিতে বিজেপি-কে দেখা যাচ্ছে। ফলে বিজেপি-র উত্থান বলে যে প্রচার করা হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন।”

কিন্তু ঘটনা হলো, জেলা সভাপতি বিজেপি-র উত্থানপর্বকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিলেও জেলা প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রীকে ঠিক তার উল্টো কথা জানিয়েছে। আবার পাড়ুই নিয়ে জেলা পুলিশের রিপোর্টে বীরভূমের ১৯টি ব্লকে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মাখড়ায় শাসক দলের আশ্রিতরাই যে হামলা চালিয়েছিল, তা-ও জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও গোয়েন্দা সূত্রে এ সব জেনেছেন। মাখড়ায় গোলমালের পরে মুকুল রায় নিজেও বীরভূমে গিয়ে কিছু খবরাখবর জোগাড় করেছেন। তিনিও ব্লকে ব্লকে তৃণমূলের প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে বিজেপি-র উত্থান হচ্ছে বলে খবর পেয়েছেন। ফলে, এ দিনের বৈঠকে নবান্নে ডেকে অনুব্রতকে কার্যত সমঝে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

তবে দলীয় সূত্রের খবর, অনুব্রতবাবু এ দিন মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, তিনি মাখড়ার হামলার ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানতেন না। বিজেপির অত্যাচারে ঘরছাড়া তৃণমূল কর্মীরা নিজেরাই গ্রামে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘরছাড়ারা সকলেই ইলামবাজার পার্টি অফিসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাড়ুই থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্তের উপর হামলার পরে মাখড়া, চৌমণ্ডলপুর এলাকায় ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। তার জেরে বিজেপির বাহিনী গ্রামছাড়া হয়ে যায়। সেই সুযোগে তৃণমূলের ঘরছাড়ারা গ্রামে ঢুকতে গিয়েছিলেন বলে মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও খবর নিয়ে জেনেছেন, ঘটনার দায় মূলত ইলামবাজারের নেতা তথা জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ জাফারুল ইসলামেরই। মাখড়ার ঘটনার পর থেকে তাঁকে আর জেলা পরিষদে দেখা যায়নি। তিনি প্রকাশ্যে দলের কোনও কর্মসূচিতেও অংশ নেননি। যে ভাবে অনুব্রত অনুগামী সুদীপ্ত ঘোষকে পদ থেকে সরানো হয়েছে, সে ভাবেই এ বার জাফারুলকেও সরানো হতে পারে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর।

পাশাপাশি, অনুব্রত যে ভাবে লাগামছাড়া হয়ে উঠছেন, সেটাও এত দিনে চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে দলের পক্ষে। এর আগেও একের পর এক ঘটনায় নাম জড়িয়েছে অনুব্রতর। তখন মমতা তাঁর পিছনেই দাঁড়িয়েছেন। ‘ভাল সংগঠক’ বলে প্রশংসা করেছেন। শেষ শক্তি পর্যন্ত পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। এমনকী অনুব্রতর পুলিশকে বোম মারার হুমকি এবং পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ হত্যার প্রেক্ষিতে আদালত যখন রাজ্য সরকারকে তিরস্কার করেছে, তখনও মুখ্যমন্ত্রী দুর্গাপুরের এক সভায় প্রকাশ্যে বলেছেন, “ও ভাল কাজ করে, আমি জানি।” লোকসভা ভোটের পর্বেও মমতা অনুব্রতর বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের একাংশ চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। “কিছু চেয়েছিল, দিসনি নাকি,’’ বলে কেষ্টকে শুধিয়েওছিলেন।

এ দিনের পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। অনুব্রত দিনে দিনে দলের মাথাব্যথাই বাড়িয়েছেন। তাই তাঁকে এখন ‘মাথা ঠান্ডা’ করতে বলতে হচ্ছে। ছেঁটে ফেলা হচ্ছে না কেন? কারণ দলের অন্দরের খবর, যে ভাবে বীরভূমের গ্রামে গ্রামে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে, তাতে দাপুটে অনুব্রত ছাড়া অন্য কারও পক্ষে তার মোকাবিলা করা যে সম্ভব নয়, সেটাও বিলক্ষণ জানেন মমতা। সেই কারণেই অনুব্রতকে ধমক দিয়ে কিংবা তাঁর অনুগামীদের শাস্তি দিয়ে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করলেও অনুব্রতকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারছেন না তিনি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy