ধর্মতলায় শহিদ স্মরণ সমাবেশে ডিএ নিয়ে তোপ মুখ্যমন্ত্রীর। —ফাইল ছবি
অসন্তোষ ফের বাড়তে শুরু করল রাজ্য সরকারি কর্মীদের মধ্যে। বেতন সংক্রান্ত দাবিদাওয়ার প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব মন্তব্য রবিবার করলেন তাঁর দলের শহিদ স্মরণের মঞ্চ থেকে, তাতে বেতন কমিশনের সুপারিশের রূপায়ণ নিয়ে ফের সংশয়ে কর্মীরা। স্পষ্ট ভাবে নাম না করলেও, প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের দিকে ইঙ্গিত করে মুখ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তার বিরুদ্ধেও মুখ খুলতে শুরু করেছে একাধিক কর্মী সংগঠন। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য অস্বস্তি বাড়িয়েছে খোদ তৃণমূলের সংগঠন ফেডারেশনেরও।
রবিবার ধর্মতলায় তৃণমূলের সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হঠাৎ দেখছি কাজ নেই-কর্ম নেই, বসে পড়ছে রাস্তায়। সবাইকে টাকা দাও আর কেন্দ্রীয় সরকারের সমান মাইনে দাও।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সমাবেশের কয়েক দিন আগে থেকেই প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি সংগঠন সল্টলেকে অবস্থান বিক্ষোভ ও অনশন শুরু করেছে। বেতন কাঠামো সংস্কারের দাবিতেই তাঁদের এই আন্দোলন। মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় যে তাঁরাই ছিলেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের সংশয় কমই ছিল। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সমান মাইনে চান, তাঁরা কেন্দ্রে চলে যান, দিল্লির চাকরি করুন। আমার কোনও আপত্তি নেই, আমি খুশি হব।’’
রবিবার বিকেল থেকেই বিরোধী দলগুলি এবং বিভিন্ন কর্মী সংগঠন তীব্র নিন্দা শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের। সোমবার আরও বেড়েছে সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
আগে মাধ্যমিক পাশ করলেই প্রাথমিক শিক্ষকতা করার যোগ্যতা অর্জন করা যেত। পরে নিয়ম হয় যে, প্রাথমিক শিক্ষকতা করার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হল উচ্চমাধ্যমিক। যাঁরা মাধ্যমিক যোগ্যতা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদেরও নির্দেশ দেওয়া হয় শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়িয়ে নেওয়ার। এই নিয়ম গোটা দেশেই প্রযোজ্য হয়।
ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতনও বাড়ানোর নির্দেশিকা জারি হয়েছিল। প্রায় সব রাজ্যই সেই নতুন নির্দেশিকা মেনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর সংস্কার করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সে সংস্কার এখনও হয়নি। বেতন কাঠামোর সেই সংস্কার চেয়েই আন্দোলনে নেমেছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা, কেন্দ্রীয় হারে বেতন চাননি— বলছে কর্মী সংগঠনগুলি। বিজেপির সংগঠন কর্মচারী পরিষদ এবং কংগ্রেসের সংগঠন কনফেডারেশনের তরফে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। কর্মচারী পরিষদের দেবাশিস শীল এবং কনফেডারেশনের সুবীর সাহা, দু’জনেই বলছেন— প্রাথমিক শিক্ষকদের অপমান করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পডু়ন: পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে গেল চন্দ্রযান-২, ইসরোর বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানালেন প্রধানমন্ত্রী
রাজ্য সরকারি কর্মীদের বেতন সংস্কার নিয়েও ধন্দ তৈরি হয়েছে রবিবারের সমাবেশের পরে। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ সাড়ে তিন বছরেও নবান্নে জমা না পড়ায় এ রাজ্যের সরকারি কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ এমনিতেই তীব্র ছিল। বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনও শুরু করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি বেতন কমিশন সূত্রেই কয়েকটি সংগঠন জানতে পারে যে, জুলাই মাসেই জমা পড়বে বেতন সংস্কারের সুপারিশ। কেন্দ্রীয় সরকার যে হারে বেতন কাঠামোয় পরিবর্তন আনে, রাজ্যকেও সেই হারেই বেতন বৃদ্ধি করার সুপারিশ বেতন কমিশন করবে বলেও কর্মী সংগঠনগুলিকে আস্বস্ত করেছিল একটি মহল। সে খবর প্রকাশ্যে আসার পরে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন সরকারি কর্মীরা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী রবিবার যা বলেন, তা ফের কর্মীদের মনে সংশয় তৈরি করে।
কী বলেন মুখ্যমন্ত্রী রবিবার? তিনি বলেন যে, বেতন কমিশনের সুপারিশ জমা পড়ুক, সেই সুপারিশের ভিত্তিতে রাজ্য সরকার ‘সাধ্যমতো’ করবে। এই ‘সাধ্যমতো’ শব্দের অর্থ কী? প্রশ্ন কর্মীদের।
কর্মচারী পরিষদের রাজ্য আহ্বায়ক দেবাশিস শীলের কথায়, ‘‘এত দিন পরে বেতন কমিশন নিয়ে সর্বসমক্ষে কথা বলতে মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য হয়েছেন। বিভিন্ন কর্মী সংগঠনের আন্দোলনের চাপেই মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এটা আমাদের নৈতিক জয়। কিন্তু কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সাধ্যমতো করব— এ কথার মানে কী? এই কথাটাই তো ফের সংশয় তৈরি করে দিচ্ছে।’’
নতুন বেতন কাঠামোর বিষয়ে বেতন কমিশন যা সুপারিশ করবে, সরকার সেই সুপারিশ কার্যকর করবে— এটাই নিয়ম। বলছেন কর্মী সংগঠনগুলির নেতারা।
কনফেডারেশনের রাজ্য স্তরের নেতা সুবীর সাহার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে করেছেন, তাতে রাজ্য সরকারি কর্মীরা ফের ধন্দে পড়ে গিয়েছেন। বেতন কমিশনের সুপারিশ জমা পড়লে সাধ্যমতো বেতন বৃদ্ধি করা হবে— এ কথার কী অর্থ আমরা বুঝতে পারছি না। সাধ্যমতো বা নিজের খেয়ালখুশি মতোই যদি বেতন বৃদ্ধি করেন, তা হলে এই বেতন কমিশন গঠন করার কী দরকার ছিল? কমিশনের নামে এত বছর ধরে বেতন বৃদ্ধি আটকে রাখা হল। এখন বলছেন সাধ্যমতো দেব!’’
আরও পড়ুন: ভর সন্ধ্যায় টলি অভিনেত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ বিজয়গড়ের রাস্তায়
কর্মচারী পরিষদের দেবাশিস শীলের কথায়, ‘‘২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দেশের সব রাজ্য কেন্দ্রীয় হারে বেতন সংস্কারের নীতি রূপায়ণ করে দিয়েছে। শুধু এই রাজ্যে হচ্ছে না।’’ দেবাশিসের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে ভুল বোঝাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় হারে বেতন সংস্কার মানে কিন্তু কিন্তু সরকারের সমান বেতন নয়। এর মানে হল, কেন্দ্রীয় সরকার বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে নিয়ম অনুসরণ করে, রাজ্য সরকারগুলিও সেই নিয়মই অনুসরণ করবে। মুখ্যমন্ত্রী সব জেনেও ইচ্ছাকৃত মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় হারে বেতন বৃদ্ধির প্রশ্নে অন্য কোনও রাজ্যের আপত্তি নেই। শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবিবারের মন্তব্য যে সরকারি কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়িয়েছে, তার আঁচ তৃণমূলের সংগঠন ফেডারেশনের নেতারাও পেয়ে গিয়েছেন। তাই বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্যে যেতে চাইছেন না ফেডারেশনের অধিকাংশ নেতা। বিরোধী পক্ষের ছাতার তলায় থাকা কর্মী সংগঠনগুলি যখন তীব্র আক্রমণ করছে সরকারকে, তখন শাসক দলের কর্মী সংগঠন চুপ। ফেডারেশনের মেন্টর গ্রুপের আহ্বায়ক মনোজ চক্রবর্তীর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘কোনও মন্তব্য করব না বলাই হল সবচেয়ে ভাল মন্তব্য।’’
সিপিএমের কর্মী সংগঠন কোঅর্ডিনেশন কমিটির শীর্ষ নেতা বিজয়শঙ্কর সিংহের প্রতিক্রিয়া অবশ্য সরকারের জন্য খুব একটা অস্বস্তিকর নয়। মুখ্যমন্ত্রীর রবিবারের মন্তব্য প্রসঙ্গে বিজয়শঙ্কর বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যে বলেছেন, সেটা আমাদের সম্পর্কে নয়, প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্পর্কে। তাই এ বিষয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া দেওয়া ঠিক নয়।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বেতন কমিশন তো মুখ্যমন্ত্রীই গঠন করেছেন। কেন্দ্রীয় হারে বেতন বাড়াবেন না মনে করলে তো বেতন কমিশনই গঠন করতেন না।’’ তবে তিনি আরও বলেছেন, ‘‘যদি দেখি কেন্দ্রীয় হারে বেতন সংস্কার হচ্ছে না বা কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা কর্মীরা পাচ্ছেন না, তাহলে আমরা আবার রাস্তায় নামব।’’
কোঅর্ডিনেশনের শীর্ষনেতা যতই আস্থা রাখুন মুখ্যমন্ত্রীর উপরে, বিজেপি এবং কংগ্রেসের সংগঠন আস্থা রাখতে রাজি নয়। কর্মচারী পরিষদ এবং কনফেডারেশন জানিয়েছে, প্রয়োজনে আরও বড় আন্দোলনে নামার জন্য তৈরি থাকবেন সরকারি কর্মীরা। বেতন কমিশনের সুপারিশ অবিলম্বে জমা না পড়লে এবং সেই সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় হারে বেতন সংস্কার না হলে নবান্ন ঘেরাও হবে বলে দেবাশিস শীল হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy