ইতিহাস ছুঁয়ে। নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি গোপন ফাইল প্রকাশের পর কলকাতা পুলিশের সংগ্রহশালায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: শৌভিক দে।
প্রায় সাত দশক ধরে লোকচক্ষুর আড়াল করে রাখা একগুচ্ছ পুলিশি-নথি। যার বিষয়বস্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। শুক্রবার দুপুরে রােজ্যর হেফাজতে থাকা এমন ৬৪টি ফাইল জনসমক্ষে প্রকাশ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বাঙালির আবেগ নয়, উস্কে দিলেন বিতর্কও। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত ওঁর কী হয়েছিল, জানি না। এই সব রিপোর্টের কয়েকটি পাতা দেখেছি, যাতে ইঙ্গিত রয়েছে যে ১৯৪৫ সালের অগস্টের পরেও নেতাজি বেঁচে ছিলেন।’’ যদিও রাজ্য পুলিশের ফাইলগুলিতে প্রাথমিক ভাবে চোখ বুলিয়ে মনে হয়নি যে, তাইহোকু বিমান রহস্য উন্মোচন হতে পারে এমন তথ্য তার অন্দরে লুকিয়ে রয়েছে।
কিন্তু মমতা জানেন, নেতাজিকে ঘিরে বাঙালির আবেগ ৭০ বছরেও প্রায় সমান অটুট। ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্ট জাপানের তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল কিনা, এই প্রশ্নে আজও সমান আলোড়িত হয় বাঙালির বৈঠক। আর তাই বিধানসভা ভোট যখন আর ছ’আট মাস দূরে, তখন নেতাজি সংক্রান্ত ফাইল প্রকাশের সিদ্ধান্তের পিছনে মমতার মোক্ষম রাজনৈতিক চাল রয়েছে, এমন জল্পনাই ঘোরাফেরা করছে রাজ্য রাজনীতিতে। বলা হচ্ছে, এক ঢিলে বেশ কয়েকটা পাখি মারলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমত, সাহসী পদক্ষেপে জিতে নেওয়ার চেষ্টা করলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত মন। যাঁদের অনেকেই বলছেন, স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক সরকার যা পারেনি, তাই করে দেখালেন মমতা। দ্বিতীয়ত, চাপে ফেললেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে। নেতাজি সংক্রান্ত ফাইলপত্র প্রকাশের দাবি বিজেপির দীর্ঘদিনের। কেন্দ্রের হাতে থাকা নেতাজি সংক্রান্ত গোপন দস্তাবেজের সংখ্যা প্রায় ৮০। ফাইল প্রকাশ করে মমতা যে শুধু নরেন্দ্র মোদীকে টেক্কা দিলেন তাই নয়, কার্যত চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিলেন তাঁর দিকে। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘নেতাজির কী হয়েছিল, জানার পথে আমরা একটা সূচনা করে দিলাম। এগুলো পাবলিককে জানানো মিনিমাম (ন্যূনতম) দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ বার আশা করব, সত্য পুরোপুরি প্রকাশিত হবে। কেন্দ্রেরও উচিত সব জানিয়ে দেওয়া।’’
তৃতীয়ত, মমতার সিদ্ধান্তে চাপে পড়ল কংগ্রেসও। কারণ, এ দিন প্রকাশিত ফাইলগুলিতে প্রাথমিক ভাবে চোখ বুলিয়ে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরেও বেশ কিছু দিন নেতাজির পরিবারের লোকজনের (যেমন নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসু, ভাইপো অমিয়নাথ বসু, শিশির বসু, অরবিন্দ বসু প্রমুখ) উপরে নজরদারি চালাত সরকার। তার পিছনে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা থাক বা না থাক, কেন্দ্র ও রাজ্যে তখন কংগ্রেসেরই সরকার। ফলে এর দায় পুরোপুরি অস্বীকার করা তাদের পক্ষে কঠিন। নেতাজির পরিবারের লোকেরা এ দিন থেকেই কংগ্রেসের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। নেতাজির ভাইপো অমিয়নাথ বসুর পুত্র চন্দ্র বসুর কথায়, ‘‘কেন আমাদের পরিবারের উপরে স্বাধীন দেশে নজরদারি চালানো হতো, একটি কমিটি গড়ে কেন্দ্র তার তদন্ত করুক।’’
চতুর্থত, নেতাজির সূত্রে ফরওয়ার্ড ব্লককে আরও কাছে টেনে বাম শিবিরে অস্বস্তি আরও তীব্র করলেন। এমনিতেই ফব নেতা অশোক ঘোষের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে দেখা করে ও তাঁকে অভিভাবক আখ্যা দিয়ে সে দলে টানাপড়েন বাড়িয়েছেন মমতা। ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাসও এ দিন এক বিবৃতিতে রাজ্যের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে কেন্দ্রকে তাদের হেফাজতে থাকা নেতাজি-সংক্রান্ত ফাইলগুলি প্রকাশের আর্জি জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ও তার পরবর্তী পর্যায়ে তৈরি ফাইলগুলি নেতাজিকে স্বাধীন ভারত থেকে দূরে রাখতে কংগ্রেস সরকারের চক্রান্ত ফাঁস করে দেবে।’’ নেতাজির আর এক ভাইপো, প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক সাংসদ সুব্রত বসুর স্ত্রী-কন্যা নন্দিতা এবং শ্রিয়া বসুও মমতাকে দরাজ গলায় অভিনন্দন জানিয়েছেন। শ্রিয়ার কথায়, ‘‘নেতাজির বিষয়ে সব তথ্য সামনে আসা উচিত। আমার বাবা (সুব্রত বসু) যখন সংসদে নেতাজির বিষয়ে কেন্দ্রকে চাপ দিয়েছিলেন, তখন মমতা ওঁর পাশেই ছিলেন। কিন্তু ইউপিএ সরকার কিছু করেনি।’’
মমতা অবশ্য নেতাজি-ফাইল এত দিন আড়ালে রেখে দেওয়ার জন্য এ দিন সরাসরি কারও দিকে আঙুল তোলেননি। তবে বার বার বলেছেন, নেতাজির শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল, স্বাধীনতার পরে ৭০ বছর পার হতে চললেও তা জানতে না-পারাটা দুর্ভাগ্যজনক। নেতাজি-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ হলে অন্য কোনও দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে বা দেশের অন্দরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্ষুণ্ণ হতে পারে— এমন যুক্তি মানতে নারাজ মমতা বলেন, ‘‘এ সব আশঙ্কা অমূলক। নেতাজির মতো দেশনেতাদের বিষয়ে তথ্য লুকিয়ে রাখা যায় না। দেশের মানুষ, নেতাজির কী হয়েছে, জানতে না-পেরে আমার মতোই কষ্টে আছেন। নেতাজির বিষয়ে ঠিকঠাক তথ্য প্রকাশিত হলে তাঁরা শান্তি পাবেন।’’ মানিকতলায় কলকাতা পুলিশের ডিসি (নর্থ)-এর সংগ্রহশালায় নথি প্রকাশের অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে কিছু ক্ষণের মধ্যে ফেসবুকেও মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ‘এ এক ঐতিহাসিক দিন। আমাদের সরকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কিত সব ফাইল জনসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছে। দেশের বীর সন্তানের বিষয়ে তথ্য জানাটা মানুষের অধিকার’।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯ সময়কালের ৬৩টি ফাইল ও ১৯২২ সালের একটি ফাইল কলকাতা পুলিশের মহাফেজখানায় রাখা হয়েছে। কলকাতা পুলিশ ও রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (আইবি) নথি সংবলিত ফাইলগুলিতে ১২ হাজার ৭৪৪টি পাতা রয়েছে। ঝুরঝুরে হলদেটে পাতাগুলো কাচের শো কেসে যত্নে রাখা ছাড়াও কম্পিউটারে ডিজিটাল সংস্করণও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নেতাজি-সংক্রান্ত এই তথ্যভাণ্ডার তুলে ধরে মমতা বলেন, ‘‘এর প্রতিটা পাতা ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট! ওপর-ওপর দেখলে হবে না। ভাল ভাবে স্টাডি করতে হবে।’’— বলতে বলতে মমতা বারবার কম্পিউটারের পর্দায় নেতাজি সম্পর্কিত কয়েকটি বিশেষ পাতায় ‘ক্লিক’ করে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি দেখান, চল্লিশের দশকের শেষে শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা একটি চিঠিতে জুরিখের এক ব্যক্তি (ডক্টর এল আবেগ) জাপানিদের কাছ থেকে নেতাজির জীবিত থাকার কথা জেনেছেন বলে দাবি করেছেন। একই সময়ে আর একটি চিঠিতে শরৎচন্দ্র বসুকে নেতাজি-জায়া এমিলি শেঙ্কলস ও কন্যা অনিতা পাফের ফটোগ্রাফ পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
‘এটা গুরুত্বপূর্ণ’-বলে চিত্রসাংবাদিকদের কিছু চিঠির ছবিও তুলতে বলেন মমতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও ঠিক তার পরবর্তী কালে গুরুত্বপূর্ণ পর্বে নেতাজি বিষয়ক তথ্য প্রকাশের জন্য প্রত্যাশা মতোই নেতাজির পরিবারের ধন্যবাদ কুড়িয়েছেন মমতা। তবে নেতাজি -দৌহিত্র পিটার অরুণ পাফ (অনিতা পাফের পুত্র) ফেসবুকে জানান, ‘আমি নথি দেখিনি। আমার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই!’ মুখ্যমন্ত্রীর দলের সাংসদ সুগত বসু (নেতাজির ভাইপো শিশির বসুর পুত্র) কলকাতায় ছিলেন না। তাঁর মা, প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ কৃষ্ণা বসুর অভিমত, ‘‘আমার মনে হয়, কলকাতা বা রাজ্য পুলিশের হাতের ফাইলগুলি থেকে হয়তো দারুণ কিছু জানা যাবে না। কিন্তু দিল্লির ফাইলগুলিতে অনেক জরুরি তথ্য আছে নিঃসন্দেহে।’’
এ দিনের অনুষ্ঠানেই ছলোছলো চোখে মমতাকে জড়িয়ে ধরেন বসু পরিবারের মেয়ে, নেতাজির ভাইঝি বর্ষীয়ান রমা রায়, চিত্রা ঘোষেরা। ব্রিটিশ সরকারকে এড়িয়ে বিদেশে পালানোর পর্বে নেতাজির অন্যতম সহযোগী ও ভাইপো, পরে দীর্ঘ দিন ব্রিটিশের জেলে বন্দি দ্বিজেন্দ্রনাথ বসুর পুত্র চিত্তপ্রিয় বসুও মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় আপ্লুত।
আর নেতাজি-আবেগে সওয়ার হয়ে মমতা যাদের টেক্কা দিতে চেয়েছেন, সেই কংগ্রেস, সিপিএম বা বিজেপি এ দিন সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলেছেন, ‘‘এই ফাইলে কী আছে, তা বিস্তারিত দেখা হোক। পরে প্রয়োজনে মন্তব্য করব।’’ কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য আবার বলেছেন, ‘‘নেতাজির এই ফাইলে গুরুত্বপূর্ণ বা গোপনীয় কোনও তথ্যই নেই। এই ফাইল দেখে নেতাজির জীবনধারা সম্পর্কে জনমানসের ধারণার বিপুল ফারাক হবে, এমন নয়।’’ আর বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিধানসভায় আমিই প্রথম দাবি করেছিলাম, রাজ্য সরকার এই কার্ডটা আগে বার করে দেখাক।’’
ফাইল গোপন রেখে দিলেই আজগুবি কাহিনি জন্ম নেয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy