‘অক্সফোর্ডের রাস্তায় হঠাৎ দেখা।’ হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলেন দিদি। উল্টো দিক থেকে গাড়ি করে আসছিলেন দাদা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই গাড়ি থামালেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তার পর চালকের পাশের আসন থেকে নেমে এসে বাংলার মহারাজ যোগ দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে।

অক্সফোর্ডের রাস্তায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
সৌরভের আগেই বাসে চড়ে অক্সফোর্ডে পৌঁছে গিয়েছিলেন মমতা। লন্ডন থেকে গাড়িতে বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয় শহরে পৌঁছোন সৌরভ। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল দু’জনের। সৌরভ পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য অতিথি মমতাকে প্রাচীন অক্সফোর্ডের নানা মাইলফলকের সামনে নিয়ে গিয়ে তার ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করেন অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ। শেল্ডনিয়ান থিয়েটার, বডলিয়ান লাইব্রেরির মতো কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় মমতাকে। শেল্ডনিয়ান থিয়েটারেই প্রতি বছর অক্সফোর্ডের সমাবর্তন হয়।

বডলিয়ান লাইব্রেরি। —নিজস্ব চিত্র।
যে গ্রন্থাগারের সামনে মমতাকে নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত নিরাপত্তার কারণে সেখানে বই বেঁধে রাখা হত শিকল দিয়ে। যদিও এখন সেই রেওয়াজ আর নেই। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ায় এই গ্রন্থাগার তৈরি করেছিলেন ইংরেজ কূটনীতিক থমাস ব়ডলে। গ্রন্থাগারে এখন বইয়ের সংখ্যা এক কোটি ৩০ লক্ষ। ব্রিটিশ লাইব্রেরির পরে এটিই বিলেতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রন্থাগার।

ডিভাইনিটি স্কুল। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রন্থাগারের সামনেই ডিভাইনিটি স্কুল। যেখানকার প্রকাণ্ড হলে হ্যারি পটারের তিনটি ছবির শুটিং হয়েছিল। ছাদে সুপ্রাচীন গথিক ভাস্কর্য। মমতা যখন সেই শিল্পকলা দেখছেন, ইতিহাস শুনছেন গাইডের মুখে, তখন ওই হলেই এক প্রবীণ অধ্যাপক জনা ১৫ পড়ুয়াকে পড়াচ্ছিলেন। কানে ‘টক ব্যাক’।
অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসের কেট স্ট্রিটে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে মার্টিন স্কুল। সেই বহুতলের গায়ে খোদাই করে লেখা ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট’। সময়ের ঘষা লেগে যে লেখা আবছা হয়ে গিয়েছে। সেই ভবন দেখাতে দেখাতে মমতাকে গাইড জানালেন, এখানেই একটা সময় পড়ানো হত আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস। রসিকতা করে অনেকে বলেন ইন্ডিয়ান কলোনিয়াল সার্ভিস)। পরাধীন ভারতের অনেকেই এই প্রতিষ্ঠান থেকে আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সারভেন্ট) হয়েছেন। স্বাধীনতার পরে অবশ্য ভারতে আইসিএস বদলে আইপিএস এবং আইএএস হয়েছে। শুনতে শুনতে মমতা মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ এবং শিল্পসচিব বন্দনা যাদবকে দেখিয়ে গাইডকে জানালেন, ওঁরা সেই ইতিহাসের উত্তরসূরি।
অক্সফোর্ডের প্রতিটি ভবন, প্রতিটি উঠোন, প্রতিটি দেওয়াল বহন করছে ব্রিটিশদের শিক্ষার ইতিহাস। ইংরেজদের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডের জন্ম একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে। প্রথমে ধর্মশিক্ষাই হত। ভারতে তার বহু আগেই (খ্রিস্টের জন্মেরও আগে) তক্ষশীলা বা নালন্দার মতো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়ে গিয়েছে। তবে নানা কারণে কালের গর্ভে তা বিলীনও হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে অক্সফোর্ড পৃথিবীর টিকে থাকা দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়।
অক্সফোর্ডে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার কিছু ক্ষণ পর মমতার অন্যান্য কর্মসূচি শুরু হয়। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজের আমন্ত্রিত বক্তা। সেই বক্তৃতার আগে ভারত বিষয়ক বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা। তবে সে সবের ফাঁকে তিনি অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এক বার হাঁটতেও বেরোন। যেমন তিনি হাঁটছিলেন লন্ডনের বিভিন্ন রাস্তায়। বুধবার লন্ডনে মমতার হন্টনের সঙ্গী ছিলেন সৌরভ-জায়া ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার অক্সফোর্ডে সঙ্গী হয়ে গেলেন সৌরভ।
বিলেতের ‘ইউনিভার্সিটি টাউনে’ মমতা হেঁটে যান কেলগ কলেজের পাশ দিয়ে। যে কলেজে পড়তেন প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খান। ঐতিহ্যশালী অক্সফোর্ড ক্রিকেট মাঠের পাশ দিয়েও হাঁটলেন মমতা। যে মাঠে খেলতেন ইমরান। তারও আগে মনসুর আলি খান পটৌডিরা। ঘটনাচক্রে ইমরান এবং টাইগার পটৌডি দু’জনেই ‘অক্সফোর্ড ব্লু’। অক্সফোর্ডের উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের তালিকায় প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের যেমন নাম রয়েছে, তেমনই নাম রয়েছে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। নাম রয়েছে অস্কার ওয়াইল্ডের। নাম রয়েছে জাপানের বর্তমান সম্রাট নারুহিতোরও।

কেলগ কলেজ। —নিজস্ব চিত্র।
অক্সফোর্ড স্ট্রিটে হন্টন শেষে কেলগ কলেজে চলে যান মমতা। সঙ্গে সৌরভ। সেখানেই আমন্ত্রিত বক্তা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।