প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের জেরে বিপাকে রাজ্যের বহু স্কুল। ঘোর বিপাকে পড়েছেন স্কুলের প্রধানশিক্ষকেরা! এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের সরকারি, সরকার-পোষিত, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং সরকার-অনুমোদিত সব স্কুলের প্রধানশিক্ষককে নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন থেকে সেই চিঠি গিয়েছে তাঁদের কাছে।
প্রশাসনিক সূত্রে খবর, বিজয়া দশমী বা নববর্ষে সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবার্তা বরাবরই এসএমএসে পাঠানো হয়। ওই তালিকায় স্কুলের প্রধানশিক্ষকেরাও থাকতেন। কিন্তু এ বার তাঁদের আলাদা করে চিঠি দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান পরিস্থিতিতে যা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন অনেকে।
এসএসসি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছে। যার জেরে স্কুলে স্কুলে এখন শিক্ষক সঙ্কট দেখা গিয়েছে। কোনও স্কুলে আগে হয়তো ২০ জন শিক্ষক ছিলেন। এখন সেখানে জনা পাঁচেক শিক্ষক। চাকরি চলে গিয়েছে বাকিদের। এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে স্কুল চালানো হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বহু প্রধানশিক্ষক। বহু স্কুলে পরীক্ষা চলছে। এর পরেই রয়েছে পরীক্ষার খাতা দেখার কাজ। পড়ুয়াদের ক্লাস তো রয়েইছে। এত কিছু সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রধানশিক্ষকদের।
প্রধানশিক্ষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, পরীক্ষার খাতা দেখা বা ক্লাস নেওয়া তো স্কুলের রোজকার কাজের মধ্যেই পড়ে। এর সঙ্গে প্রশাসনিক কাজও রয়েছে। যেমন— চাকরিহারা শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের বেতনের কী হবে, ‘স্যালারি রিকুইজিশন’ পাঠানো হবে কি না, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কোনও চাকরিহারা শিক্ষক স্কুলে পরিষেবা দিতে চাইলে তাঁকে অনুমতি দেওয়া বা হাজিরা খাতায় সই করতে দেওয়া হবে কি না, স্কুলে পড়ুয়াদের প্রথম পর্বের পরীক্ষা ও পঠনপাঠন কী ভাবে স্বাভাবিক রাখা যাবে, পার্শ্বশিক্ষকদের কর্মবিরতি কী ভাবে সামলানো হবে— এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন এখন তাঁদের সামনে। পড়ুয়াদের পরীক্ষা নিতে অভ্যস্ত প্রধানশিক্ষকেরাই এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে। প্রশাসনিক মহলের একাংশের মত, প্রধানশিক্ষকদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে এ বার তাঁদের আলাদা করে নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা চিঠি পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, সরকার তাঁদের পাশেই রয়েছে। তাঁরা যাতে এই পরিস্থিতিতে হাল না ছাড়েন।
যদিও বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির নেতা স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘নববর্ষের এই শুভেচ্ছাবার্তা শিক্ষক সমাজের জন্য একেবারেই শুভ নয়। এই সরকার শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের কতটা খারাপ চোখে দেখে, তা কসবার ডিআই অফিসের ঘটনায় প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। শিক্ষকের পেটে লাথি মেরেছেন কলকাতা পুলিশের এক জন এবং পুলিশমন্ত্রী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী সেই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেননি। তাই এমন শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়ে শিক্ষকদের মন ভোলানো যাবে না।’’
পশ্চিমবঙ্গ প্রধানশিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণাংশু মিশ্রও বলছেন, ‘‘এর আগেও আমরা মুখ্যমন্ত্রীর বিজয়া শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছি। তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বহু শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, ২০০০ ছাত্রছাত্রীর স্কুলে পড়ানোর জন্য ১০-১২ জন শিক্ষক রয়ে গিয়েছেন! এই অবস্থায় স্কুলগুলি ভাল করে চলবে কী ভাবে, তা নিয়ে আমরা চিন্তায়। তাই মুখ্যমন্ত্রীর এই চিঠিতে আমাদের কী প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত, জানি না। সঙ্গে এটাও বলব, একই সঙ্গে শিক্ষকদের পেটে লাথি এবং শুভেচ্ছাবার্তার বিষয়টিকেও কীভাবে দেখব? তা নিয়েও দ্বিধায় রয়েছি।’’
তবে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি বিজন সরকার মনে করছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সর্বোচ্চ পদাধিকারী। তিনি যখন প্রধানশিক্ষকদের নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন, তা স্কুলের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া উচিত। আমরা মনে করি, মুখ্যমন্ত্রীর এই শুভেচ্ছাবার্তা যথেষ্ট ইতিবাচক। আমরা এই বার্তাকে স্বাগত জানাচ্ছি।’’