কালীঘাট থেকে ভার্চুয়াল সমাবেশে বক্তৃতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মঙ্গলবার। পিটিআই
তৃণমূলের রাজনৈতিক লক্ষ্য যে এখন আগামী বিধানসভা নির্বাচন, তা স্পষ্ট ছিলই। সেই লক্ষ্যের ‘পাখির চোখ’ নির্দিষ্ট করে দিয়ে এ বার বিজেপির জামানত বাজেয়াপ্ত করার আহ্বান জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘২০২১ সালের মে মাসের নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয় হবে তৃণমূলের। তার পরে ২১ জুলাই বৃহত্তম সমাবেশ হবে। এখন থেকেই তার প্রস্তুতি চলবে।’’
তৃণমূলের সব থেকে বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি ২১ জুলাইয়ের ‘শহিদ স্মরণ।’ বিধানসভা ভোটের আগে এ বারের ২১-এর এই শেষ সভায় একেবারে ভোটের বাদ্যি বাজিয়ে দিয়েছেন মমতা। কোনও রাখঢাক না-করেই এ দিনের সভা থেকে বিজেপিকে নিশানা করে তিনি বলেন, ‘‘বাংলার রাজনীতিতে কোনও দিন তাঁদের দেখিনি। এই বহিরাগতরা বাংলা চালাবে না। গুজরাত ( মোদী-শাহের রাজ্য) থেকে কি উত্তরপ্রদেশ, বিহার, তামিলনাড়ু আর বাংলাকে চালানো হবে? বাংলাকে চালাবে বাংলার লোকেরাই।’’ এই প্রসঙ্গেই মমতার প্রশ্ন, ‘‘এক জাতি এক দলের তত্ত্ব চালাতে চাইছে। তা হলে এত দলের দরকার কী? বিচারব্যবস্থা বা নির্বাচন কমিশন আছে কেন?’’
এ বারের ২১ জুলাই ছিল একেবারেই অন্যরকম। করোনা পরিস্থিতিতে চিরাচরিত ভাবে ধর্মতলায় সমাবেশের প্রশ্ন ছিল না। কলকাতা-সহ রাজ্যের সাড়ে ৬২ হাজার বুথে ভিডিয়োর মাধ্যমে দলনেত্রীর বক্তৃতা দেখা-শোনার বন্দোবস্ত করেছিল তৃণমূল। কালীঘাটের বাড়ির অফিস থেকে মমতা বক্তৃতা করেন ঠিক সভামঞ্চের মতো দাঁড়িয়ে। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী এবং একুশ জুলাই কর্মসূচির উদ্যোক্তা হিসেবে যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ভার্চুয়াল সভার সুযোগে মমতা তাঁর সামনে রাখা পর্দায় বিভিন্ন জেলায় উপস্থিত দলীয় কর্মীদের দেখতে পাচ্ছিলেন। দার্জিলিংয়ের কর্মীদের দেখে এক সময় তিনি হিন্দিতেও কিছু কথা বলেন। অপর দিকে শ্রোতাদের তরফ থেকেও নানা ভাবে তাঁদের নেত্রীকে সমর্থন জানানো হয়।
আরও পড়ুন: বাংলা নিয়ে জরুরি বৈঠক সপ্তাহ জুড়ে, দিল্লি যাচ্ছে গোটা রাজ্য বিজেপি
বিজেপির সঙ্গে এই লড়াই যে এখন তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের, এ দিন সেই বার্তা দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলতে অনেকে ভয় পায়। কাল থেকেই আমার বিরুদ্ধে হয়তো অত্যাচার হবে। আমি ভয় পাই না। বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছি। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছে বলে গায়ের জোর দেখাচ্ছে।’’ তার পরেই তৃণমূল নেত্রীর হুঁশিয়ারি, ‘‘আমাদের এত দুর্বল ভেবে লাভ নেই। আহত বাঘ বেশি বিপজ্জনক।’’
২১ জুলাইয়ের ভার্চুয়াল সভায়। মঙ্গলবার হাওড়ার দাসনগরে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
বাংলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বিজেপির অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে এনে এ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘দিল্লির সরকার চক্রান্তের জোতদার, চক্রান্তের অংশীদার হয়ে কাজ করছে।’’ অন্য রাজ্যের অবস্থা উল্লেখ করে মমতার প্রশ্ন, ‘‘বাংলায় আইনশৃঙ্খলা নেই? তা হলে কোথায় আছে? দিল্লিতে আছে? উত্তরপ্রদেশে আছে? সেখানে তো এনকাউন্টার চলছে। জঙ্গলরাজ বললেও কম বলা হয়। থানায় ডায়েরি করতে যাওয়ার আগে খুন করে দেওয়া হচ্ছে! পুলিশকে যে খুন করল, তাকেও খুন করে দেওয়া হল। কেন? বিহার, অসম, ত্রিপুরায় কেমন সরকার চলছে?’’
কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টানাপড়েন নিয়েও বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচিত সরকার ভাঙার অভিযোগ করেছেন তৃণমূলনেত্রী। তাঁর বক্তব্য, টাকা ছড়িয়ে মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, রাজস্থানে সরকার ভাঙা হবে? বাংলায়ও কি সরকার ভাঙা হবে?’’ পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা, এই রাজ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিজেপি যে ভাবে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত দরবার করেছে এবং রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় সোমবারই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে রাজ্য সরকারকে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এবং দুর্নীতির পাহাড় বলে অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে মমতার মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন: ভোটের পরে ২১ জনও মিলবে না, কটাক্ষ দিলীপের
করোনা এবং আমপান পরিস্থিতি ছাড়াও নাগরিকত্বের বিষয়টিও যে রাজ্যে নির্বাচনে সামনে আসবে, বিজেপি নেতৃত্ব আগেই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ দিন নাগরিকত্ব আইনের প্রসঙ্গ টেনে মমতাও বলেন, ‘‘এনপিআর-এনআরসি’র লড়াই আমরা ভুলে যাইনি। কী ভাবে দিল্লিতে মানুষগুলোকে খুন করে নালায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনার জন্য সে সব ভুলে যাব?’’ কটাক্ষের সুরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘জেলাশাসক নাগরিকত্ব দেবেন। নতুন করে কিসের নাগরিকত্ব দেবেন আপনারা?’’
লোকসভা ভোটে রাজ্যে একধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। এ দিনের বক্তৃতায় সেই প্রসঙ্গ টেনে মমতা বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটে কয়েকটা আসন পেয়ে কী নাচানাচি করছে, বাপ রে!’’ এই প্রসঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিজেপিকে জেতালে কী হয় তা ব্যারাকপুর-ভাটপাড়ার মানুষ বুঝতে পাচ্ছেন। জঙ্গলমহলে নতুন করে অশান্তি তৈরির চেষ্টা করছে। পাহাড়কে অশান্ত করার চেষ্টা চলছে। রাজবংশী-কামতাপুরীদের নিয়ে বিভাজনের প্ররোচনা চলছে।’’ তার পরেই বিজেপির বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ করে মমতার আবেদন, ‘‘ভুল করেও বিজেপিকে বিশ্বাস করবেন না। বিজেপিকে বিশ্বাস করলে জীবনও যাবে। জীবিকাও যাবে।’’
বিজেপির বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে সিপিএম বা কংগ্রেসকে গুরুত্ব দিতে চাননি তৃণমূলনেত্রী। বরং এই দুই দলের নেতা-কর্মীদের কাছে তাঁর আবেদন, ‘‘এখনও যাঁরা কংগ্রেসে পড়ে আছেন, তৃণমূলে চলে আসুন। যাঁরা সিপিএমে আছেন তৃণমূলে চলে আসুন।’’ সেই সঙ্গেই যাঁরা ‘ভুল করে’ বিজেপিতে চলে গিয়েছেন তাঁদেরও দলে ফেরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলই রাজ্যে সুশাসন দিতে পারবে।’’
অনেকের প্রশ্ন, তৃণমূল থেকে যাঁরা বিজেপিতে চলে গিয়েছেন তাঁদের ফিরে আসার আহ্বান জানানোর মধ্যে দিয়ে তৃণমূলনেত্রী কি দলের পুরনো ‘সংসার’ আবার নতুন করে জোড়া দিতে আগ্রহী? দলের এক শীর্ষনেতার অবশ্য বক্তব্য, যাঁরা ভুল বুঝে বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের যে প্রতিদিন স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে সেটা বুঝেই মমতা তাঁদের পথ করে দিতে চান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy