তেখালির জনসভায় তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।
নাম করলেন না। কিন্তু নন্দীগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে অধিকারীদের (বিশেষত, শুভেন্দু অধিকারীকে) ছত্রে ছত্রে বিঁধলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামের তেখালির বিশাল জনসভা থেকে তাঁর মন্তব্য, ‘‘রাজনীতিতে একদল ভোগী। একদল ত্যাগী। যারা ত্যাগ করতে জানে, তারা মায়ের কোল, আম্মার কোল ছাড়ে না। হাজার মার মারলেও তারা প্রতিবাদ করবে।’’ তার পরেই তাঁর বক্তব্য, ‘‘আর এক দল আছে। যারা লোভী। যাদের প্রচুর সম্পত্তি। প্রচুর টাকা। সেই টাকাও আছে ঢাকা। সেই টাকা যাতে বাইরে বেরিয়ে না পড়ে, সে জন্যই সব কারবার।’’ নন্দীগ্রাম থেকেই ২০২১-এ জেতার পালা শুরু হল বলে জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘নন্দীগ্রামে তৃণমূলের নতুন জন্ম হল।’’ যা তিনি বলেননি, সেই নতুন তৃণমূল ‘অধিকারী-রহিত’। অর্থাৎ, কাঁথির অধিকারী পরিবারের সঙ্গে সেই নন্দীগ্রামের কোনও সম্পর্ক থাকবে না। সে যা ছিল, সব গতজন্মে।
মমতার বক্তব্যে এসেছে বিজেপি-তৃণমূলের পারস্পরিক লড়াইয়ের নির্যাস। তিনি বলেছেন, ‘‘বিজেপি বলছে, টিএমসি করলে জেলে। নয়তো ঘরে। অর্থাৎ, বিজেপি করলে সব কালো সাদা হয়ে যাবে। ওয়াশিং পাউডার বিজেপি! তা যারা গিয়েছো, তারা যাও। তোমরা প্রধানমন্ত্রী হও। তোমরা রাষ্ট্রপতি হও। আমায় কেউ চোর বলতে পারে। খারাপ কথা বলতে পারে। আমি কারও সম্পর্কে একটাও খারাপ কথা বলব না!’’ সম্প্রতি যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে গিয়েছেন, তাঁদের নিয়ে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘কেউ কেউ ইধার-উধার করছে। অত চিন্তা করার কারণ নেই। তৃণমূলের জন্মদিনে তো তোমরা ছিলে না! তখন তো এই নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হয়েছিল অখিল গিরি। দ্বিতীয় হয়েছিল। প্রথম হয়েছিল সিপিএম।’’ ওয়াকিবহালরা জানবেন, মমতা কটাক্ষ করতে চেয়েছেন অধিকারী পরিবারকে। যাঁরা তৃণমূলের জন্মের অনেক পরে কংগ্রেস ছেড়ে তাঁর দলে যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেস ছেড়ে মমতা যখন তৃণমূল গঠন করেছিলেন, তখন অধিকারীরা সকলেই ছিলেন কংগ্রেস। তাঁরা মমতার সঙ্গে দল ছাড়েননি।
বেশ কয়েক বছর পর নন্দীগ্রামে জনসভা করলেন মমতা। ভিড়ে উপচে-পড়া সেই সভা থেকে মমতা যেমন ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে তিনিই নন্দীগ্রাম থেকে লড়বেন, তেমনই বার বার বলেছেন, নন্দীগ্রামকে তিনি ভোলেননি। নন্দীগ্রামের সঙ্গে তাঁর ‘আত্মার টান’ রয়েছে। নন্দীগ্রামের জন্য নানাবিধ প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করেছেন তিনি মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার মমতার সভামঞ্চে হাজির ছিলেন নন্দীগ্রাম আন্দোলনে শহিদ পরিবারের সদস্যরা। বস্তুত, সভা শুরুর আগেই মমতা নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় নিখোঁজ ১০ জনের পরিবারকে ৪ লক্ষ টাকা করে অর্থসাহায্যের কথা ঘোষণা করেন। আগামিদিনে নন্দীগ্রামে কী কী কাজ হবে, তার একটা রূপরেখাও মঞ্চ থেকে ঘোষণা করেন মমতা।
আরও পড়ুন: শুভেন্দুর ডেরায় মাস্টারস্ট্রোক, নন্দীগ্রামে মমতা নিজেই ভোটপ্রার্থী
বক্তৃতা করতে করতেই মমতা জানিয়েছেন, নন্দীগ্রামকে তিনি কতটা চেনেন। সেখানে কোথায় কোন দোকানে কী পাওয়া যায়, সে হদিশও দিয়েছেন। সভা থেকে মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, নন্দীগ্রামের সঙ্গে তিনি চিরকাল থাকবেন। তাঁর কথায়, ‘‘তেখালি বলুন, সোনাচুড়া বলুন, সারা নন্দীগ্রামে যতগুলো জায়গা আছে, নন্দীগ্রামে কোথায় হ্যালেঞ্চা বড়া পাওয়া যায়, আমি সেই দোকানটাও চিনি। সুপিয়ানের বাড়ি চিনি। আবু তাহেরের বাড়ি চিনি। নন্দীগ্রামের বাজারও চিনি। নন্দীগ্রামের কলেজ চিনি। নন্দীগ্রামের হাসপাতালও চিনি। নন্দীগ্রামের এলাকাগুলো চিনি। কারণ, নন্দীগ্রামের সঙ্গে আমার আত্মার টান। আমার আন্দোলনের টান। যা চিরকাল ছিল। যা আছে। যা থাকবে।’’
আরও পড়ুন: টিভি-তেও মমতার নন্দীগ্রামের সভা দেখলেন না শিশির-দিব্যেন্দু
নিজের ভাষণে মমতা আরও জানিয়েছেন যে, তিনি নন্দীগ্রাম নিয়ে বইও লিখেছেন। স্লোগান লিখেছেন, ‘ভুলতে পারি নিজের নাম, ভুলব না কো নন্দীগ্রাম’। মমতা বলেছেন, ‘‘কী করে ভুলব রক্তস্নাত সেই দিনগুলোর কথা। আজ তো নন্দীগ্রাম অনেক উন্নত হয়েছে। কিসান মাণ্ডি হয়েছে। কর্মতীর্থ হয়েছে। কলেজ হয়েছে। মাল্টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হয়েছে। অনেক কিছুই হয়েছে।’’ এর পরেই স্থানীয়দের বেশ কয়েকটি দাবির কথা তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ‘‘এখানকার মানুষের অনেক দিনের দাবি, নন্দীগ্রাম ও হলদি নদী ঘিরে একটা সেতু তৈরির। কিন্তু আমি জানি না খরচ কত লাগবে। দেখে নিয়ে নিশ্চয়ই আগামিদিনে ভাবব আপনাদের জন্য। নন্দীগ্রাম-হলদিয়ার মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হবে। সোনাচূড়া টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট চান। আগামিদিনে সেটাও হয়ে যাবে।’’ নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষ প্রচুর কাজ পাবেন। তাঁরা মাথা তুলে দাঁড়াবেন বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী । নন্দীগ্রাম ১ এবং ২, চণ্ডীপুর ও নন্দকুমার ব্লকে ৭০ হাজার পরিবারের বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছতে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘নন্দীগ্রাম শুধু আন্দোলনের জায়গা নয়। একটা স্যালুটের জায়গা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy