ভোটে সাফল্য আসুক বা না আসুক, বাম আমলে রাস্তার লড়াইয়ে কখনও পিছপা ছিলেন না বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সরকারের আমলে রাস্তার আন্দোলনে শিথিলতা কাটাতে পারছে না বিরোধী দল সিপিএম। জেলায় জেলায় দলের সম্মেলনে উঠে এসেছে লড়াই-আন্দোলনে ‘অনীহা’র প্রসঙ্গ।
আর জি কর-কাণ্ডের রেশ ধরে জাল স্যালাইন ও ওষুধ ব্যবহারের প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে পথে নামার ঘোষণা করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। স্যালাইন-কাণ্ডকে সামনে রেখে স্বাস্থ্য-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন করে সরব হয়েছে সিপিএম। মেদিনীপুর হোক বা কলকাতা, এই প্রতিবাদের সামনের সারিতে রয়েছেন দলের যুব নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। এই ঘটনা একটি নজির মাত্র। বারেবারেই দেখা যাচ্ছে, প্রতিবাদ-আন্দোলনের ঘোষণা হচ্ছে রাজ্য স্তরে, কেন্দ্রীয় ভাবে কর্মসূচি হলে চোখেও পড়ছে। কিন্তু স্থানীয় স্তরে আন্দোলনের ধার-ভার কিছুই নেই! এই প্রবণতার কথাই দলের জেলা সম্মেলন-পর্বে কাটাছেঁড়ায় এসেছে।
সিপিএম সূত্রের খবর, আন্দোলনের সম্মুখ সমরে নামতে নিচু তলার অনীহা কেন, তার নেপথ্যে মূলত দু’রকমের কারণ জেলা সম্মেলনের আলোচনা থেকে চিহ্নিত হচ্ছে। প্রথমত, সরকার থেকে বিদায় নেওয়ার পরে এক যুগ কেটে গেলেও দলের একাংশের মধ্যে ‘জড়তা’ এখনও কাটেনি। শাসক দলে থাকাকালীন যে ভূমিকায় ওই অংশ অভ্যস্ত ছিল, তার থেকে বেরিয়ে আসতে তারা পারছে না বা চাইছে না। স্থানীয় স্তরের কমিটিতে এই অংশের অনেকটা প্রতিনিধিত্ব এখনও রয়ে গিয়েছে বলেই আন্দোলন, প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্থানীয় স্তরে শাসক দলের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’র অভিযোগও আছে। আর দ্বিতীয়ত, প্রতিবাদী কোনও কর্মসূচি হলেই পুলিশ-প্রশাসনের ধরপাকড়, মামলা-মোকদ্দমার ঝক্কি কর্মী-সমর্থকদের একাংশকে ‘বিমুখ’ করে তুলছে। দলের কর্মীদের নবীন অংশ রাস্তায় নেমে কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু পুলিশ-আদালতের সমস্যায় তাঁরা যাতে না জড়িয়ে পড়েন, তার জন্য পরিবার-সহ তাঁদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের চাপ থাকছে। দলের রাজ্য নেতৃত্ব ‘মিথ্যা মামলা’ মোকাবিলা করে এগোনোর কথা বললেও নিচু তলায় এই পরিস্থিতির চাপ পড়ছে।
বাংলার রাজনীতিতে সচরাচর দেখা গিয়েছে, যে কোনও পরিস্থিতিতে প্রতিরোধের রাস্তায় এগিয়ে থাকেন সংখ্যালঘু এবং তফসিলি অংশের মানুষ। রাজ্যে ইদানীং কালের যা রাজনৈতিক সমীকরণ দাঁড়িয়েছে, তার নিরিখে সংখ্যালঘুদের বড় অংশে তৃণমূল কংগ্রেস এবং তফসিলির বিরাট অংশে বিজেপির প্রভাব রয়েছে। যার ফলে প্রান্তিক, গরিব মানুষের সমর্থনের ভিত অনেকটাই সিপিএমের দিক থেকে সরে গিয়েছে। নানা জেলার নানা রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে যে ছবি পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে সিপিএমের এক রাজ্য নেতার মত, ‘‘গরিব মুসলিমদের একাংশ এবং হিন্দু মধ্যবিত্তের একটা অংশে বামেদের প্রভাব এখনও কাজ করছে। এই অংশের মানুষ যেখানে আছেন, সেখানে দলের নড়াচড়াও আছে।’’ এই সূত্রেই সিপিএমের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, হুগলি জেলা এবং কলকাতার শহরতলি ও উত্তর ২৪ পরগনার একাংশে দলের স্থানীয় স্তরের সক্রিয়তা তুলনামূলক ভাবে বেশি। দুই ২৪ পরগনায় তৃণমূল-বিরোধী সংখ্যালঘুদের বড় অংশ আবার চলে গিয়েছে নওসাদ সিদ্দিকীর দল আইএসএফের সঙ্গে। নদিয়া, মুর্শিদাবাদে সেই অংশের কাছাকাছি এখনও রয়েছে সিপিএম।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘উপর থেকে সব রকম চেষ্টা করলেও স্থানীয় স্তরের অংশগ্রহণই মূল কথা। সেখানে সক্রিয়তা না-বাড়লে পরিস্থিতি বদলানো কঠিন।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)