Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ফুলের ঘায়ে ফুল ফোটানোর লড়াই

গোয়ালতোড়ের যে জমিতে গাড়ি কারখানা হওয়ার কথা, সেখানে খাপছাড়া নীল পাঁচিল দেখিয়ে হরেকৃষ্ণ মাহাতো, সুদর্শন মাহাতোরা বলছেন, এই মেঠোপথ পেরিয়ে কখনও শিল্প আসে!

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৯ ০৩:২৬
Share: Save:

ঘামঝরা পোড়া দুপুর। বান্দোয়ানের পথে কাঠের বোঝা মাথায় কমলা পাল, মণি কুম্ভকারদের গলাতেও ঝাঁঝ, ‘‘ন্যাতাদের ঘরে সব শ্যালো ঢুকি গেল। আর আমাদের কাঠ নামিয়েই ছুটতি হবে জল আনতে।’’

নয়াগ্রামের বিক্রম মান্ডির গলা নিস্তেজ। ভিন্‌ রাজ্যে দিনমজুরি করা তরুণের আক্ষেপ, ‘‘এখানে কোনও কাজ নেই। আর চাকরিতে তো শুধু টাকার খেলা।’’

গোয়ালতোড়ের যে জমিতে গাড়ি কারখানা হওয়ার কথা, সেখানে খাপছাড়া নীল পাঁচিল দেখিয়ে হরেকৃষ্ণ মাহাতো, সুদর্শন মাহাতোরা বলছেন, ‘‘এই মেঠোপথ পেরিয়ে কখনও শিল্প আসে!"

ছোট প্রাণের এমনই সব ছোট ছোট দুঃখ-কথা গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে ব্যথা দিয়ে ছিল দিদির দলকে। রব উঠেছিল, জঙ্গলমহলের হাসি বুঝি মুছে গিয়েছে।

ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর আর পুরুলিয়া— তিন জেলায় ছড়ানো ৭ বিধানসভা নিয়ে ঝাড়গ্রাম লোকসভা। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে নয়াগ্রাম, লালগড় কিংবা গড়বেতা— তৃণমূলের আমলে উন্নয়ন দৃশ্যতই ছড়িয়ে রয়েছে। রাস্তা, সেতু, কিষান মান্ডি, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, নার্সিং ট্রেনিং কলেজ, পলিটেকনিকের নীল-সাদা বাড়ি সর্বত্র। ঘরে ঘরে দু’টাকার চাল, সবুজ সাথী, রূপশ্রী, কন্যাশ্রী। ভুলাভেদায় মাওবাদীদের হাতে খুন হওয়া সিপিএম নেতা অসীম মণ্ডলের স্ত্রী অনিতাও মানছেন, ‘‘এখানে কাজ হয়েছে। ক্ষতিপূরণও পেয়েছি।’’

কাজ আর মাওবাদী নাশকতা শেষে শান্তি— জোড়া প্রাপ্তির জঙ্গলমহল ২০১১-র পরেও বারবার জোড়া ফুল ফুটিয়েছে। ৫০%, ৫২%, ৫৫ %— লাফিয়ে বেড়েছে তৃণমূলের ভোটপ্রাপ্তি। ধাক্কাটা আসে গত বছর পঞ্চায়েতে। ৩ লক্ষ ৪৭ হাজারে জেতা ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের চারটি বিধানসভা যে জেলায় সেই ঝাড়গ্রামে তৃণমূলের ভোট নেমে আসে ৪৭%-এ। আর বিজেপি ৯% থেকে বেড়ে হয় ৩৯.৪৪%। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, শালবনির কিছু এলাকাতেও পদ্ম ফোটে৷ তৃণমূলের মন্ত্রী, বিধায়কের গ্রামেও জেতে বিজেপি। অবস্থা বুঝে ঝাড়গ্রামের ভার খোদ দলের মহাসচিবকে সঁপেছেন তৃণমূল নেত্রী। বিজয়ী সাংসদকে বদলে তুলে এনেছেন নতুন মুখ, বিরবাহা সরেন।

কাপগাড়িতে তাসা বাজিয়ে এগোনো মিছিলের সামনে বিরবাহা। নামের মানে বুনোফুল হলেও গলায় গাঁদার মালা। বললেন, ‘‘দিদির কাজ দেখেই লোকে ভোট দেবে।’’ কিন্তু পেশায় শিক্ষিকা এই বিরবাহাকে প্রার্থী করার পরই তো ভেঙেছে আদিবাসী সমাজ। সাঁওতালিদের সামাজিক সংগঠনের পদ হারিয়েছেন বিরবাহার স্বামী রবিন টুডু৷ পরে রবিন পদে ফিরলেও সমাজ আর রাজনীতি এক হয়ে যাওয়ায় যাঁরা খেপেছেন, তাঁদের ভোটটা কী হবে? বিরবাহা প্রত্যয়ী, ‘‘এ সব ফ্যাক্টরই নয়। আমার তো মনে হচ্ছে এখনই বিজয় মিছিলে হাঁটছি।’’

জয় দেখছেন পদ্ম-প্রার্থী কুনার হেমব্রমও। আদিবাসী সমাজে সমাদৃত আইআইটির ইঞ্জিনিয়ার কুনার বলছেন, ‘‘কতগুলো ফাঁকা বিল্ডিংয়ের ফাঁপা উন্নয়ন, নেতাদের চুরি আর কাজের আকালই এ বার তৃণমূলের কাল হবে।’’

বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি সুখময় সৎপথীর আবার ভবিষ্যবাণী, ‘‘গড়বেতা ছাড়া কোথাও লিড পাবে না তৃণমূল।’’ এত প্রকল্পের উপভোক্তা, সবাই দিদির বিরুদ্ধে যাবে? সুখময় বলছেন, ‘‘যারা তৃণমূলের হয়ে ভোট করাতো, তারা আমাদের হয়ে ভোট করাবে। ২৩ মে মিলিয়ে নেবেন।’’

২৩ মের হার-জিতে অবশ্য নজর নেই কংগ্রেসের। দিল্লি দখলের লড়াইয়ে থাকা জাতীয় দল ঝাড়গ্রামে লড়ছে অস্তিত্ব রক্ষায়। প্রার্থী যজ্ঞেশ্বর হেমব্রমের প্রচারে লোকের মাথা হাতে গোনা যাচ্ছে। জেলা সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে কংগ্রেসকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতেই আমাদের লড়াই।’’

লজঝরে সংগঠন নিয়ে ময়দানে বামেরাও। প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম লড়াকু, ব্রিগেডের পরে চেনা মুখ। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক পুলিনবিহারী বাস্কে। পুলিন বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েতে বহু জায়গায় তৃণমূল-বিজেপির হাত ধরাধরি মানুষ মেনে নেয়নি। মাওবাদী পর্বে শয়ে শয়ে খুনের পিছনেও যে তৃণমূল, সেটা লোকে বুঝেছে।’’ দেবলীনা আশাবাদী, ‘‘বনবাসী জনজাতিকে উচ্ছেদ করতে মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে আমাদেরই জেতাবে জঙ্গলমহল।’’

পঞ্চায়েতের হিসেবে অবশ্য স্পষ্ট, জঙ্গলমহলেও লালের ঘরের সিঁদ কাটছে গেরুয়াই। ২০১৪-র লোকসভায় ২৫% ভোট পাওয়া বামফ্রন্ট ঝাড়গ্রাম জেলায় ২০১৮-র পঞ্চায়েতে নেমে এসেছে ১১%-এ।

অঙ্ক বলছে বিরোধী ভোটে যত কাটাকুটি, তত ভরবে শাসকের ঝুলি। সেই হিসেবে বিজেপি, বাম, কংগ্রেসের পাশাপাশি ঝাড়খণ্ডী জোট প্রার্থী সাঁওতালি অভিনেত্রী বিরবাহা হাঁসদা, মুন্ডা সমাজের মিত্তন সিংহ-সহ গুচ্ছ প্রার্থীর লড়াইয়ে তৃণমূলের জয়ে কাঁটা থাকার কথা নয়। আর বামেরা নিজেদের সামন্য ভোট ধরে রাখলে তো ঘাসফুলের গোড়ায় আরও

জল পড়বে। তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম

জেলা চেয়ারম্যান সুকুমার হাঁসদাও বলছেন, ‘‘বেশি বিরোধীতে তো আমাদেরই লাভ।’’ আর ক্ষোভের আঁচ? হাসছেন সুকুমার, ‘‘ও সব পদ্মপাতায় জল।’’

‘‘কৌশলে কিন্তু ঘাসফুলের বনেও পদ্ম ফোটে’’— বলেই ওড়িয়া প্রবাদ শোনালেন বিজেপির এক

মেজো নেতা, ‘মরিব মরিব, কৌশল করি মরিব!’

আদিবাসী পাড়ায় আবার ঘুরছে, ‘বিরবাহা নহে, দা বাহা’। দা বাহা মানে জলের ফুল।

গোলাপের যুদ্ধের সাক্ষী ব্রিটিশ ইতিহাস। তবে এমন ফুলেল যুদ্ধ কবে দেখেছে সিদো-কানহো-বিরসার বনতল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy