ভোটার কার্ড হাতে আরতি ঘোষ। —নিজস্ব চিত্র।
ফোকলা দাঁতে আরতি ঠাকুরমার হাসিটার মধ্যে মিশেছিল ভরপুর আত্মবিশ্বাস। শীর্ণ হাতের মুঠোয় ৯০ বছরের জীবনে পাওয়া প্রথম ভোটার কার্ড। চেতলায় মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ভবঘুরে মহিলাদের হোম থেকে আরও কয়েক জন সহ-আবাসিকদের সঙ্গে এ বারই প্রথম তিনি ভোট দিতে যাবেন।
প্রায় সাত বছর ধরে এই হোমের বাসিন্দা আরতি ঘোষকে কালীঘাট অঞ্চলের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে এলোমেলো ঘুরতে দেখেছিলেন পাড়ার লোক। স্মৃতিভ্রষ্ট, বিড়বিড় করে বকে চলা, উলুঝুলু রাস্তার ‘পাগলি’ তিনি তখন। সেখান থেকে পুলিশ নিয়ে যায় স্থানীয় নার্সিংহোমে। তার পর এই হোমে। দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রায় সুস্থ নবতিপর বৃদ্ধা এখন হোমের সবার আদরের দিদা। গত সপ্তাহে এই হোমের ৫৫ জন আবাসিকের নামে নির্বাচন কমিশন থেকে ভোটার কার্ড এসেছে। সেই কার্ড হাতে নিয়ে বৃদ্ধা বলেন, ‘‘পাগলি যে চিরকাল পাগলি থাকে না, তা বোঝে কত জনে? নিজের ভোটটা দিয়ে সবাইকে সেটা বোঝাতে হবে।’’
আগে কোনও দিন ভোট দেননি? আরতি বলেন, ‘‘লখনউয়ে বাড়ি ছিল। বাবা অফিসের বড়বাবু। খুব কড়া। আমাকে বাইরে বেরোতেই দিত না। ভোট দিতে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই।’’ তার পর একটু থেমে মন্তব্য, ‘‘রাস্তায় তো সবাই ঢিল মারত, কুকুরের মতো খাবার ছুড়ে দিত। সেই আমি কোনও দিন ভোট দিয়ে দেশের নেতা ঠিক করতে পারব, ভাবিনি গো নাতনি।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ যাতে লোকসভা ভোটে শামিল করতে পারেন, এই প্রথম তার জন্য বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হয়েছে নির্বাচন কমিশন। মনোরোগীরাও ‘সাইকোসোশ্যালি ডিজ়েবলড’ বা মনোসামাজিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে পড়ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনোরোগ স্থায়ী অবস্থা নয়। চিকিৎসার ফলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। যাঁরা এই সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, তাঁদের ভোটার কার্ড করা হয়েছে। এ রাজ্যে মানসিক রোগীদের সমস্ত হোমের পাশাপাশি সরকারি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বহু রোগীও সেই কার্ড পেয়েছেন। এঁদের অনেকে জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাবেন, কিংবা দীর্ঘ বিরতির পর আবার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন।
মানসিক রোগীদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সর্বাণী দাস রায়ের মতে, ‘‘মনোরোগীরা সুস্থ হয়ে ওঠার পরেই তাঁদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যেন বদলাতে চায় না। ‘মাথা খারাপ’ এর তকমা মুছে মূলস্রোতে ফেরাটা দুরূহ হয়ে ওঠে। সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষদের ভোটার কার্ড দিয়ে কমিশন এই ভ্রান্ত ধারণার মূল ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁদের মতামতকে স্বীকৃতি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
এই আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী রত্নাবলী রায় বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম নজিরবিহীন একটা কাজ হয়েছে। বিভিন্ন মানসিক হাসপাতাল বা হোমের আবাসিকদের নামে যে ভোটার কার্ড তৈরি হয়েছে, তার ঠিকানার জয়গায় কোথাও ‘মেন্টাল হসপিটাল’ বা ‘হোম’ বলে লেখা নেই। শুধু রাস্তার নাম ও নম্বর রয়েছে। যাতে পরবর্তীকালে চাকরি, ব্যাঙ্ক বা অন্য কোথাও পরিচয়পত্র হিসাবে এই কার্ড দেখালে তাঁদের সমস্যা বা ভেদাভেদের মুখে পড়তে না-হয়।’’ পশ্চিমবঙ্গে পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতালে ৪৪ জনের, বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে ৬৫ জনের এবং পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ৫৪ জনের নামে ভোটার কার্ড এসেছে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে কার্ড তৈরির ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে কিছু প্রশাসনিক সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তাই কার্ড পেতে দেরি হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে তা হয়ে যাবে।
চেতলার ‘ঈশ্বর সঙ্কল্প’ নামে ভবঘুরে মানসিক রোগীদের আবাসে নিজের-নিজের কার্ড অমূল্য সম্পদের মতো যত্নে ট্রাঙ্কে তুলে রেখেছেন বছর পঁয়ষট্টির শ্যামলী পাল থেকে শুরু করে বছর একুশের হরিপ্রিয়া। শ্যামলী ছিলেন ভেদিয়ার এক স্কুলের পদার্থবিদ্যার দিদিমণি। মানসিক সমস্যায় ঘরছাড়া হয়েছিলেন। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হলেও ছেলে বাড়ি ফেরাতে আগ্রহী নন। চোখের চশমাটা ঠিক করে ব্যক্তিত্বময়ী শ্যামলী বলেন, ‘‘যে সরকারই আসুক, তারা যেন অসহায় মানসিক রোগীদের চিকিৎসার ও আশ্রয়ের সুব্যবস্থা করে। আমারও তো মাথা খারাপ হয়েছিল। চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়েছি, না পেলে রাস্তায় নোংরা খেয়ে ঘুরতাম।’’
বছর দু’য়েক আগে আঠারো বছরের বাপ-মা মরা ফুটফুটে সুন্দর কিশোরীকে মুম্বই থেকে ট্রেনে কলকাতায় নিয়ে আসেন মামা। তার পর অপরিচিত শহরে নিউমার্কেট এলাকায় তাকে একলা ছেড়ে উধাও হয়ে যান। আতঙ্কে, দুঃখে মানসিক স্থিতি হারিয়েছিলেন হরিপ্রিয়া কৈরালা। এখন সে সুস্থ হয়ে কম্পিউটার শিখছে, একটি ক্যাফেতে কাজ করছে। প্রথমবার ভোট দিতে চলেছে সে। রোগাপাতলা কিশোরীর দৃঢ় গলায় হিন্দিতে বলা কয়েকটি লাইন ঘরের ভিতর যেন গর্জে ওঠে, ‘‘মামা-কে দেখাতে চাই, আমি মরে যাইনি, পাগল হয়ে গিয়েও আবার সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছি, আমি ভোট দিচ্ছি মামা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy