Advertisement
২৩ জানুয়ারি ২০২৫

ছিপটি মাপাই একমাত্র কাজ

বাম আমলে সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার পরে বিয়াল্লিশ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি।

সেতুবন্ধ: রায়ডাক নদীতে আজও ভরসা বাঁশের নড়বড়ে সেতু। ছবি: শুভ কর্মকার

সেতুবন্ধ: রায়ডাক নদীতে আজও ভরসা বাঁশের নড়বড়ে সেতু। ছবি: শুভ কর্মকার

গৌতম চক্রবর্তী 
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪৯
Share: Save:

এখানে সবাই ছিপটি মাপে!

সকালবেলায় তুফানগঞ্জ থেকে বেরিয়ে চলে এসেছি অসম সীমান্তের কাছাকাছি জালধোয়া, ফলুইমারি গ্রামের দিকে। দু’পাশে জঙ্গল, নীল আকাশ। এখানে জাগলা দিয়ে সঙ্কোশ, রায়ডাক, শালডাঙা নদী পেরিয়ে ও পারে যেতে হয়।

জাগলা বুঝলেন না? বাঁশের নড়বড়ে, অস্থায়ী সেতু। যাতায়াত করতে করতে বাঁশের ফাঁকফোকর বেড়ে গেলে সেখানে সাইকেলের টিউব গুঁজে দেওয়া হয়। বাম আমলে এ-সব জায়গায় সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার পরে বিয়াল্লিশ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি। এখন ছিপটি মাপাই একমাত্র কাজ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ছিপটি শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম এখানকার ইমান মিয়াঁ, আসারউদ্দিন মিয়াঁর কাছে। ভোরবেলায় রায়ডাক নদীতে দু’চারটে নৌকা। ইমান, আনসারউদ্দিনরা নৌকা থেকে দড়ি বাঁধা বালতি নামিয়ে দিচ্ছেন। লোহার বালতির নীচে পাঁচ-সাতটা ফুটো। এ বার বালতি তুললে জল নীচে ঝরে পড়ে যাচ্ছে, বালিটা ওঁরা আলাদা করে রাখছেন। নৌকোয় কত বালি ধরে? ইমানেরা চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘এটায় ১২০ ছিপটি। বড় নৌকো হলে তা ধরেন, ১৬০ ছিপটি হইয়ে যায়।’’

ছিপটি মানে, শহুরে অঙ্কে সিএফটি। কিউবিক ফিট। রাস্তা, বাড়িঘর তুলতে এই যে সিমেন্ট, বালি-পাথর লাগে, সেগুলি এই নদী থেকে আনসারেরা জোগান দেন। ছাদ ঢালাইয়ের কাজে লাগবে, এমন মোটা দানার বালি-কাঁকর তুললে এক সিএফটিতে সাড়ে তিন টাকা। দেওয়ালে পলেস্তারার কাজে আর একটু মিহি বালি। তার দাম আড়াই টাকা সিএফটি। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বালি তোলার কাজ করেন আনসারেরা। বালি, পাথর নিতে দিনহাটা, কোচবিহার, অসম থেকে লরি আসে।

জাগলা পেরিয়ে ও-পারে জালধোয়া গ্রামে প্রথমে এক গরুর খোঁয়াড়। বাস রাস্তার ধারের গ্রামগুলিতে গরু রাখার জায়গা নেই, ফলে লোকে নদী পেরিয়ে এখানে গরু রাখে। প্রায় ৮০টা গরু। সুবল সাহনি নামে এক বিহারি বৃদ্ধ সেগুলির দেখাশোনা করেন। তাঁর বয়স ৭৫। দুপুরে জাগলা পেরিয়ে ও পারে এক-এক জনের বাড়িতে খেয়ে আসেন। রাতে নিজেই দুটো রুটি বানিয়ে নেন। ছেলেমেয়ে নেই, স্ত্রী সত্তরের দশকে অসমের দাঙ্গায় মারা গিয়েছেন। ঘোলাটে চোখে, নড়বড়ে মাজা নিয়ে সুবল জানালেন, স্ত্রীর নাম তাঁর মনে নেই। দাঙ্গা আর দারিদ্র কি স্মৃতিতেও পলি ফেলে যায়?

এখানে হাসপাতাল নেই, দু’ জন হাতুড়ে আছেন। তাঁরা জ্বরজ্বারিতে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ দেন। টাকুয়ামারি গ্রামে এক দোকানে দুপুর বারোটায় ক্যারাম পিটছে ক্লাস সেভেনের বিশ্বজিৎ বর্মণ। দোকানে ২২ টাকা কেজির মোটা বোল্ডা ও সরু চালের মেলানোমেশানো খুদ কিনতে এসেছে মীনেশ্বরী রাভা। আর দশ টাকার বাকড়। ‘‘কী হবে?’’ উত্তর এল, ‘‘গরুতে খাবে।’’ বলতেই হল, ‘‘ঠিক করে বল। নিজেরা খাবি না?’’ ঝকঝকে চোখের ইশারা হেনে হাসল রাভা তরুণী। ওই খুদ আর বাকড়েই রাভা বস্তিতে দিশি মদ তৈরি হয়।

জঙ্গলের পাশ দিয়ে মহিষকুচি ব্লকের রাস্তা। নামের জন্যই মনে পড়ে গেল কোচবিহারের সেই লেখককে। অমিয়ভূষণ মজুমদার। তাঁর ‘মহিষকুড়ার উপকথা’ উপন্যাসে জাফরুল্লার মোষ চরাত আসফাক। এখন দেখছি, গ্রামগুলিতে সবই গরুর গাড়ি। সোহরাব শেখের একটা ঘোড়া আছে। সেই ঘোড়ার গাড়িতে সোহরাব বক্সিরহাটে ধান, পাট, কাঠ নিয়ে যায়। ‘‘মোষের অত ঘাস কে জুগান দিবে?’’ নদীর ভাঙন, ঘাসের অভাবে মহিষকুচিতে আর মোষ নেই।

দুপুরবেলা ফলুইমারি গ্রামে দেখা আহমেদ মিঞার সঙ্গে। মোটরসাইকেলে শাড়ি, জামার গোছা নিয়ে জাগলা পেরিয়ে গ্রামে গ্রামে ফিরি করে সে। আগে নদী থেকে বালি, পাথর তুলত। ‘‘ওই কাজে শরীরে বেশিদিন দেয় না। হাঁফ ধরে যায়। ওই তো সুরঞ্জন, আমরা এক সঙ্গে বালি তুলতাম। এখন সুরঞ্জনও আর পারে না, গরু দেখে।’’

আহমেদ আর সুরঞ্জন পাশাপাশি বসে বিড়ি ধরাল। এর পরও রামমন্দির নিয়ে জিগির তোলে কোন মূর্খ? মহিষকুড়ার শেষ লাইন মনে পড়ে, ‘শহরের রাজারা, যারা রাজ্য চালায়, তারা পোষ-না-মানা কোনও মর্দা মোষকে নিজের ইচ্ছামতো বনে চরতে আর কোনও দিনই দেবে না।’

আহমেদ আর সুরঞ্জন কিন্তু এখনও নিজেদের ইচ্ছামাফিক আড্ডা মারে। সাহিত্যের মহিষকুড়া নয়,আজকের মহিষকুচির বাস্তব উপকথা!

অন্য বিষয়গুলি:

Mahishkuchi Lok Sabha Election 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy