.
রোদ ঝলসানো দুপুরে পুরুলিয়া-জামশেদপুর ৩২ নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে গাড়ি ঢুকছে বলরামপুরের সুপুরডি গ্রামের দিকে। ঢালাই রাস্তার মাঝেমাঝে ভাঙাচোরা। গ্রামের ঢোকার মুখে প্রথম বাড়িটার সাদা দেওয়ালে সেই ছড়াটা এখনও আছে। ছড়ার বয়স এক বছর। রোদ-জলে অনেকটাই ফ্যাকাশে হয়ে এলেও শেষ দু’টো লাইন পড়া যাচ্ছে— ‘আর করো না ভুল, তাড়াও তৃণমূল’।
ঠিক এক বছর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে এই ছড়া ও পদ্মফুল প্রতীক যিনি এঁকেছিলেন, সেই তরুণের রহস্য-মৃত্যু ঘিরে তোলপাড় হয়েছে পুরুলিয়া এবং রাজ্য রাজনীতি। ত্রিলোচন মাহাতো পঞ্চায়েতেই প্রথম বার ভোট দিয়েছিলেন। সেই ভোটের আগেই আঠারোয় পা পড়েছিল তাঁর। পঞ্চায়েত ভোটের পরে ২৯ মে বিকেলে নিখোঁজ হলেন। ঝুলন্ত দেহ মিলল পরের দিন গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলের গাছে। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত এক তৃণমূলকর্মীর বাড়ি ত্রিলোচনের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরে। মোটরবাইক নিয়ে হুশ করে তাঁকে চলে যেতে দেখে নিমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিলোচনের বড়দা বিবেক বললেন, ‘‘ভাই মরেছে। দেওয়াল লেখা কিন্তু থামেনি। আমরাই লিখছি।’’ ভাইয়ের লেখা ছড়ার প্রথম দু’লাইনও বলে দিলেন, ‘পুঁতেছিলাম ঘাস, হয়ে গেল বাঁশ...’
সুপুরডি থেকে বেরিয়ে ফের জাতীয় সড়কে উঠে বলরামপুর বাজার। যে দিকে চোখ যাচ্ছে দেওয়ালে পদ্মফুল। ঘাসফুল আছে ঠিকই। চোখের দেখা যদি মাপকাঠি হয়, তা হলে মানতেই হবে, এখানে দেওয়াল-প্রচারে ঢের এগিয়ে বিজেপি। সেখানেই পদ্ম-পোস্টারে ছয়লাপ ছোট্ট পার্টি অফিসে বসে বিজেপির জেলা সম্পাদক বাণেশ্বর মাহাতোর দাবি, ‘‘ত্রিলোচন, দুলাল কুমারের মতো কর্মীর মৃত্যু মানুষ ভোলেনি। লিখে নিন, বলরামপুরে আমরাই জিতছি।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তাঁর এই আত্মবিশ্বাসের কারণ অবশ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল। এক সময়ে মাওবাদী নাশকতার জন্য শিরোনামে থাকা এই জেলায় ২০১৪-র লোকসভা ভোটে যে বিজেপির ঝুলিতে সাকুল্যে ৭ শতাংশ ভোট ছিল, চার বছর পরে পঞ্চায়েতের হিসেব ধরলে তা এক লাফে পৌঁছেছে প্রায় ৩৬ শতাংশে! বলরামপুর ব্লকে সেটাই ৪৭ শতাংশ! পঞ্চায়েত ভোটের ফলের নিরিখে রঘুনাথপুর-২, পাড়া ও জয়পুর ব্লকেও বিজেপি এগিয়ে তৃণমূলের থেকে। অতএব নামে চতুর্মুখী লড়াই হলেও জঙ্গলমহলের এই জেলায় তাই প্রতিপক্ষ আসলে দুই। তৃণমূল এবং বিজেপি। আর কেউ কোথাও নেই। দেওয়ালে, প্রচারে, চায়ের দোকান থেকে হোটেল, স্টেশন থেকে বাজার— চর্চা শুধুই তৃণমূল না বিজেপি, জিতবে কে?
দু’দলেরই দাবি, জিতবে তারা। পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটের হিসেব ধরলে রাজ্যের শাসক দলের আপাত কোনও চিন্তা নেই। দ্বিতীয় হওয়া বামেদের সঙ্গে তৃণমূলের ব্যবধান ছিল দেড় লক্ষেরও বেশি। এ বারও দল প্রার্থী করেছে বিদায়ী সাংসদ, পেশায় চিকিৎসক এবং ভদ্র ও সজ্জন বলে পরিচিত মৃগাঙ্ক মাহাতোকে।
কিন্তু, তৃণমূলকে চিন্তায় রেখেছে পঞ্চায়েতে বিজেপির ‘অবিশ্বাস্য’ ফল। সেই ঝড়ে উড়ে গিয়েছেন খোদ তৃণমূলের দাপুটে জেলা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো। তাঁর ‘ঔদ্ধত্য’ ও ‘দুর্নীতি’ই নাকি বলরামপুরে বিপর্যয়ের কারণ— এই মতবাদ এখনও দলের অন্দরে ঘোরে। উন্নয়ন যে হয়েছে, তা মানছেন বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারাও। কিন্তু, তাঁরাই বলছেন, ‘‘টিএমসির কিছু নেতা আমাদের গরু-ছাগল ভাবতে শুরু করেছিল। টাকা ছাড়া কোনও কাজ হচ্ছিল না।’’ ড্যামেজ কন্ট্রোলে দলের নির্দেশে সৃষ্টিধরবাবুর এখন দলে কোনও ‘কাজ’ নেই। যদিও তা মানতে চাইছেন না তিনি। জাতীয় সড়ক ঘেঁষা নিজের ইট-বালি-পাথরের গুদামের বাইরে বসে বলে দিচ্ছেন, ‘‘আমি কাজ করছি তো। কর্মীদের বোঝাচ্ছি।’’
শুনে হাসছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। তিনি আবার বলরামপুরেরই বিধায়ক! সারা দিন কর্মিসভা করে বিধ্বস্ত শান্তিরামবাবুকে পাওয়া গেল পুরুলিয়া শহরের অস্থায়ী অফিসের ঘরে। এসি মেশিনের ঠান্ডায় ঘাম মুছে বললেন, ‘‘সৃষ্টি কাজ করছে বুঝি? ভাল তো!’’ তবে স্বীকার করলেন, লড়াই এ বার কঠিন। জেলা বিজেপি সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী এবং পুরুলিয়ার
দলীয় প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো, দু’জনেই দাবি করছেন, ‘‘তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের যে বিস্ফোরণ পঞ্চায়েতে ঘটেছিল, সেটা এক বছরে মিলিয়ে যায়নি। বরং গোটা জেলায় তৃণমূল-বিরোধী প্রবল হাওয়া রয়েছে।’’ যা শুনে শান্তিরামবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘পঞ্চায়েতের ফল যে খারাপ হয়েছে, তা মানছি। কিন্তু, পরিস্থিতি এখন অনেক ভাল।
তা ছাড়া, স্রেফ হাওয়া দিয়ে তো ভোট হয় না! সংগঠন লাগে। সেই সংগঠন কোথায় ওদের?’’
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোট সাড়ে পাঁচ লক্ষেরও বেশি। তৃণমূল নেতাদের মতে, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বাম-কংগ্রেসের প্রার্থী কার্যত ছিল না। ফলে সেই ভোট বিজেপি-তে গিয়েছিল। লোকসভায় অন্য ছবি। এখানে ওই দুই শিবির যত ভোট টানবে, ততই তাঁদের লাভ। রঘুনাথপুর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া গ্রামে প্রচারের ফাঁকে তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্কবাবুও বললেন, ‘‘একের বিরুদ্ধে এক লড়াই হলে কী হত, বলা মুশকিল। চার দলের লড়াই কিন্তু আমাদেরই সুবিধা দেবে।’’
এই অঙ্ক মানতে নারাজ জেলা কংগ্রেস সভাপতি এবং ২০১৪-র পরে আবার পুরুলিয়ার দলীয় প্রার্থী নেপাল মাহাতো। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা তবে কী করতে মাঠে নেমেছি? শুনুন, আমার ভোট অটুট থাকবে। বরং বামফ্রন্টের কিছু ভোট আমিও পাব।’’
অন্য দিকে, বিজেপি শিবিরের আশা, বাম-কংগ্রেস ভোটের বড় অংশ তাদের দিকে ঝুঁকে পুরুলিয়া আসনে ঘাসফুলকে হারিয়ে জয়ী হবে পদ্মফুলই। বিজেপির যেটা আশা, বাম-শিবিরে সেটাই আশঙ্কার কারণ। কংগ্রেস, সিপিএম দু’দলের একাধিক নেতা একান্ত আলোচনায় আক্ষেপ করেছেন, এ বার জোটের প্রার্থী থাকলে লড়াইটা অন্য রকম হত। ভোটও বাড়ত। কিন্তু, সমঝোতা ভেঙে যাওয়ায় আখেরে ফায়দা লুটবে বিজেপি। পঞ্চায়েতের ফলের নিরিখে বিজেপির আর এক শক্ত ঘাঁটি পাড়া ব্লকে দলীয় কার্যালয়ে বসে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীননাথ লোধা বলছিলেন, ‘‘বিরোধী পরিসরটা আমরা কিছুতেই নিতে পারছি না। তাই আমাদের আশঙ্কা, বাম সমর্থকদের বড় অংশ পঞ্চায়েতের মতো এ বারও পদ্মফুলে বোতাম টিপবেন স্রেফ তৃণমূলকে হারানোর জন্য।’’
পুরুলিয়ার ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী, চার বারের সাংসদ বীরসিংহ মাহাতোর সখেদ মন্তব্য, ‘আমার তো ভাই সিংহ আঁকার লোকই নেই!’’ ঘটনা যে, এত বারের সাংসদের জন্য ফ্রন্টের ‘বড়দা’ সিপিএম-কে সে ভাবে পথে নামতে দেখাও যাচ্ছে না।
শান্তিরাম মাহাতো বিজেপি-র ‘দুর্বল’ সংগঠনের কথা বলে বাম-ভোটের গেরুয়া শিবিরে যাওয়ার আশঙ্কা নস্যাৎ করতে চাইছেন। বাস্তব চিত্রটা কি সত্যিই তাই?
ট্রেন থেকে পুরুলিয়া শহরে নামা ইস্তক কিন্তু চোখে পড়েছে বাড়ির ছাদে ছাদে রাম ও হনমুানের পতাকা। ছোট-বড়-মাঝারি, সব সাইজের। শয়ে শয়ে টোটো, মোটরবাইক ও সাইকেলেও তাই। এই শহরের বাসিন্দা, প্রবীণ আইনজীবী বলছিলেন, ‘‘পুরুলিয়ার এই চেহারা আগে কখনও দেখিনি। কতটা ভয়ে, কতটা ভক্তিতে, বলতে পারব না। তবে রামের নামে যে ভোট হচ্ছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই।’’
সব মিলিয়ে পুরুলিয়ার এ বারের ভোট তাই সেখানকার বাসিন্দাদের বড় অংশের কাছেই ‘অচেনা’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy