—ফাইল চিত্র।
হলিউডের পরিচালক অলিভার স্টোন ‘জেএফকে’ (১৯৯১) নামে একটি ছবি বানিয়েছিলেন, সেখানে নানা রকম তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র জিম গ্যারিসন প্রমাণ করেন যে, কেনেডির মৃত্যুতে একক হত্যাকারী হিসেবে যাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, সেই লি হার্ভি অসওয়াল্ড আসলে এক বিরাট রাজনৈতিক চক্রান্তের বলির পাঁঠা। কেনেডিকে যে ভাবে খতম করা হয়েছিল, তা কোনও একক ব্যক্তির কাজ হতে পারে না। তাঁর শরীরে যে বুলেটগুলো প্রবেশ করেছিল, সেগুলি আলাদা আলাদা অ্যাঙ্গল থেকে এসেছিল। কেনেডি আসলে ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং যুদ্ধসমাপ্তির সিদ্ধান্ত নেবেন-নেবেন করছিলেন। যুদ্ধ থেমে গেলে, অস্ত্র কেনাবেচা বন্ধ হলে কিছু ক্ষমতাবান ব্যবসাপতির কোটি কোটি ডলারের লোকসান। এঁরা তা মেনে নেবেন কেন? সিআইএ এবং এফবিআই— এই দুটি রাষ্ট্রীয় গুপ্তচর ও গোয়েন্দা সংস্থার মাথারা এই সব ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ।
এই সমান্তরাল সত্যটি আমার কাছে চলে আসায় ভাবতে বাধ্য হলাম: দেশ চালায় আসলে কারা? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক পদাধিকারীরা। কিন্তু অনেক সময়ই তাঁরা ব্যবসাপতি এবং যুদ্ধবাজদের ক্রীড়নক মাত্র। মূল কথাটি হল, প্রধান মুনাফাভোগীদের অর্থের জোগান যেন কখনও না বন্ধ হয়। সেটা করতে গেলেই একেবারে বোলতার চাকে ঢিল পড়বে। রাষ্ট্রপ্রধানরাই বাঁচবেন না, সাধারণ মানুষ তো দূর অস্ত!
এই ‘জেএফকে’ ছবিটি যখন দেখি, তখন আমি কলেজছাত্র। পলিটিকাল সায়েন্স বিষয়টি পাঠ্যক্রমে ছিল। সেখানে তখন পড়তে হচ্ছে— পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। লক্ষ করে দেখবেন— পরিকল্পনাকারীরা কিন্তু বারবার শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক লগ্নির কথা বলেছেন। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, সত্যিই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য এটা প্রয়োজন। কিন্তু বারবার আমরা কী দেখলাম? ‘ছিপ নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে/ মাছ নিয়ে গেল চিলে’। ছিপ: শিক্ষাখাত, মাছ: স্বাস্থ্যখাত, কোলাব্যাঙ: সামরিক খাত, চিল: প্রতিরক্ষাখাত। এ সব দেখেশুনে এই প্রশ্ন তো মাথায় আসবেই— তবে কি এদেশেও আমরা যুদ্ধব্যবসায়ীদের হাতের পুতুলে পর্যবসিত? এই প্রশ্নের লেজ ধরে চলে আসে আর একটা প্রসঙ্গ: ব্রিটিশরা চলে যান, শাসকদের গায়ের রঙ পাল্টায়, স্বভাব কি পাল্টায়?
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আমার মাতামহ আফতাবুল ইসলাম ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কংগ্রেসি নেতা ছিলেন, নেতাজিকে বহু কাজে সহযোগিতা করেছিলেন, কারাবাস করেছিলেন বহুবার। নেতাজির ডাকে কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লকে চলে এসেছিলেন কি না ঠিক জানা নেই। মনে হয় কংগ্রেসেই থেকে গিয়েছিলেন। কারণ আমি শুনেছি স্বাধীনতার পর তাঁকে মন্ত্রিত্ব অফার করা হয়েছিল। তিনি নেননি। এই খণ্ডিত স্বাধীনতা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। বাংলাদেশের খুলনায় চলে যান, সাধুবাবা হয়ে গিয়ে এক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পরিবার রয়ে গিয়েছিল কলকাতায়। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী স্বাধীনতাকে অস্বীকার করলেন, তাকে স্রেফ সুযোগসন্ধানী ক্ষমতার হস্তান্তর মনে করলেন— এই কাহিনি পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে আমি শৈশবেই শুনতে পাই। ফলে এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য আমার কোনও দিনই তৈরি হয়নি। পাশাপাশি স্কুলে ইতিহাস ক্লাসে ফরাসি বিপ্লব পড়াতে গিয়ে শিক্ষক শ্রীচিত্তরঞ্জন রায় যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন বিপ্লব আর বিপ্লবীর, যে ভাবে বুঝিয়েছিলেন বিদ্রোহ কোনও শৌখিনতা নয়, কত যন্ত্রণা সহ্য করে তৈরি হন এক-একজন মানববোমা— আমি বিপ্লবীদের ভালবাসতে শিখেছিলাম। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সুস্থ প্রবৃত্তিগুলোকে কাঁচকলা দেখিয়ে যাঁরা অস্ত্রব্যবসায়ীদের সাহায্য করে গিয়েছেন বরাবর, আমি সেই প্রশাসনের পক্ষ নিতে পারিনি। আমি থেকে যাই সংগ্রামীদের পক্ষে।
যারা দেশের মানুষের প্রয়োজনে প্রশাসনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে, প্রয়োজনে নিজের প্রাণ তুচ্ছ করতে পারে। যারা মানচিত্র নিয়ে নয়, মানুষের উপর হওয়া অত্যাচার নিয়ে মাথা ঘামায়। আমার কাছে এরাই, উদয়ন পন্ডিতরাই সাচ্চা দেশপ্রেমিক। দেশ যারা চালাচ্ছেন বেশির ভাগ মানুষকে অশিক্ষিত রেখে দিয়ে যাতে ভোট পড়ে না-ভেবেচিন্তে, দেশ যারা চালাচ্ছেন ইংরেজদের শিখিয়ে যাওয়া ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিকে মাথায় রেখে ধর্মে ধর্মে হানাহানি তৈরি করে, দেশ যারা চালাচ্ছেন সরকারি হাসপাতাল আর বেসরকারি হাসপাতালের সুবিধামাত্রার বিরাট তারতম্যকে দেখেও না দেখে— সেই সব হীরক রাজা আর তাঁর ‘ঠিক ঠিক‘ মন্ত্রে দীক্ষিত পোষ্য চামচা মন্ত্রীদের আমি অন্তর থেকে দেশদ্রোহীই মনে করি। ভোটবাগীশ নেতাদের অন্ধ অনুসরণ দেশপ্রেম নয়, দেশের মানুষের উপর অত্যাচার হলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই দেশপ্রেম।
এই বোধের সঙ্গে যোগ হয় কিছু ব্যক্তিগত অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। জীবনের ৩৩ বছর যে বাড়িটিতে কাটিয়েছি, সেই বাড়িতে আমার অংশে জল আসত না। এটা কিন্তু কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল নয়, শহরের কেন্দ্রে, থিয়েটার রোডে। বহু ঘোরাঘুরি এবং বহুবার দেড় দু’হাজার টাকা খরচ করবার পর আমার কাছে ১৬ হাজার টাকা দাবি করে কলকাতা কর্পোরেশন। আমি তখন মাসে মাইনে পাই (একজন প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে) চার হাজার টাকা। অত টাকা পাব কোথায়? এর সঙ্গেই চালু ছিল নানা রকম গুন্ডামি, মস্তানি। আমাদের বাড়িসংলগ্ন কিছু কিছু অংশ জবরদখল করে নেওয়া হচ্ছিল। পেছনে উঠোনের দরজা অন্যায় ভাবে ব্লক করে বাথরুম বানানো হচ্ছিল। এর প্রতিরোধে কাউন্সিলরের কাছে গিয়ে জনৈক পেশিপ্রদর্শনকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাই। পুলিশ আসে। ও বাবা! তারা দেখি ওই ব্যক্তির সঙ্গেই মিলেমিশে হাসাহাসি করছে। বুঝতে পারি, ওরা সবাই সরকারের লোক। আমরা অত্যাচারিত জনগণ, আসলে সরকারের কেউ নই।
আমি আমার জীবনে এই সমাজের দু’টি অর্থনৈতিক শ্রেণির পর্যায়ভুক্ত হয়ে থেকেছি। আমি যেমন ক্ষমতাহীনদের স্কুল দেখেছি, তেমনই দেখেছি ক্ষমতাবানদের। আমি যেমন সরকারি হাসপাতালের চরম দৈন্য আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সহ্য করতে বাধ্য হয়েছি, তেমনই দেখেছি সুবিধাভোগী শ্রেণির অভ্যন্তর। আমার বিবেক আজও অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের পক্ষে। এখনও পর্যন্ত আমাদের শাসকগোষ্ঠীর কোনও প্রতিনিধিকে আমি একটি ভোটও দিইনি। সত্তর বছরের কথার খেলাপ যাঁদের মুকুটের পালক, তাঁদের আমি কী করে নিজের নেতা মানব?
যে যুদ্ধনীতি, প্রতিরক্ষানীতি মানুষকে স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে, শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখল, পকেট ভরল অস্ত্রব্যবসায়ীদের আর কিছু নেতাঘনিষ্ঠ ব্যবসাপতির, আজ সেই নীতির বিজ্ঞাপন নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে নেতাদের মধ্যে! কে ক্রেডিট নেবেন! আর আবার সেই নিরীহ বোকা মানুষের মস্তিষ্কে রোপণ করা হচ্ছে যুদ্ধের বীজ, মলম দেওয়া হচ্ছে ফাঁকা জাতীয়তাবোধের, যেন অবারিত ক্রিকেট আর যৌনতার ওভারডোজ আর যথেষ্ট নয়! যুদ্ধপ্রীতি এখন দারুণ ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে দেবে, যেমন ভোট বাড়াবে ব্রিটিশ বিভেদপন্থীর চালু করে যাওয়া ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’!
এ সব দেখেশুনে রাগ যত না হয়, হতভম্ব হয়ে যাই তার চেয়ে বেশি। তার পর বুঝে ফেলি রাজনীতির আসল মানে। ‘রাজনীতি’ তো ‘লোকনীতি’ ছিল না কখনও, লোকের স্বার্থ নয়, রাজার পকেট রক্ষাই ছিল তার দায়িত্ব, যা সে চিরকাল পালন করে এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy