সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার ও কাকলি ঘোষ দস্তিদার। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক জন বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী, আর এক জন তিন বারের সাংসদ। তবে রাজনীতির সমান্তরালে স্বামী-স্ত্রী মিলে বেশ কয়েক দশক ধরে হাজার হাজার স্বামী-স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করে আসছেন। লকডাউনে তুমুল প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে সে কাজেই। কিন্তু সমাধানের পথও এ সবের মধ্যেই খুঁজে নিয়েছেন রাজনীতিক তথা চিকিৎসক দম্পতি। ‘‘৩৫-৪০ বছর ধরে দু’জনে মিলে কাজ করছি, নেটওয়ার্কটা নেহাত মন্দ তো নয়,’’—স্মিত হাসি মাখিয়ে বলছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় ছাত্র। অতএব পরিবহণ ব্যবস্থা প্রায় স্তব্ধ হয়ে থাকার মাঝেও অন্তত ৩০ আইভিএফ শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখালেন সুদর্শন-কাকলি।
রাজনীতিতে নয় নয় করে অনেক বছর কাটিয়ে দিয়েছেন সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার এবং কাকলি ঘোষ দস্তিদার। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী ছিলেন কাকলি। ২০০৯ সাল থেকে বারাসতের সাংসদ, টানা তিন বার জিতেছেন। আর ২০১১ থেকে মহিষাদলের বিধায়ক সুদর্শন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু ডাক্তারি নিয়ে ‘প্যাশন’ বিন্দুমাত্র কমেনি। করোনা আবহে ক্লিনিক বা চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক চিকিৎসকই। রাজনীতিকদের কারও কারও সতর্কতা তো আরও অনেক বেশি। কিন্তু সুদর্শন-কাকলির তৈরি জিডি ইনস্টিটিউট ফর ফার্টিলিটি রিসার্চের দরজা নিরন্তর খোলা। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা হয় সেখানে, অর্থাৎ আপৎকালীন চিকিৎসার ব্যাপার নয়। চাইলে আপাতত হাসপাতাল বন্ধ করে দিতেই পারতেন হাই-প্রোফাইল দম্পতি। সামাজিক দূরত্ব বিধি, লকডাউন বিধি, পরিবারের সুরক্ষা— নানা অজুহাত দিয়ে দিতেই পারতেন। কিন্তু এত বছর রাজনীতির অলিন্দে কাটিয়েও রাজনীতিকের কণ্ঠস্বর বেরোয় না সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারের গলা থেকে। বরং ভারতে টেস্ট টিউব বেবির জনক তথা ‘প্যাশনেট’ চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রিয় ছাত্র’ পরিচয়টাই এখনও সবচেয়ে বেশি প্রিয় তাঁর। ‘‘ডাক্তারি আমার প্যাশন, এটা ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারি না,’’ বলাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি।
১৯৭৮ সালে ভারতে প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। পৃথিবীতেও সে বছরই প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জন্ম। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কর্মপদ্ধতি নিয়ে দেশেই কী রকম সমালোচনা, কী রকম রোষ তৈরি হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন টেস্ট টিউব বেবির জনক। তবে প্রিয় ছাত্র সুদর্শন লড়াই ছাড়েননি। কোমর বেঁধে নামেন গুরুর কাজকে প্রতিষ্ঠা দিতে। আইভিএফ ক্লিনিক খোলেন। গোটা দেশকে চমকে দিয়ে ১৯৮৬ সালে ফের কলকাতায় টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দেন। পরে ২০০৫ সালে এশিয়ায় প্রথম কোনও সারোগেট মায়ের গর্ভে আইভিএফ শিশুর জন্মও তাঁর হাত ধরেই।
আরও পড়ুন: কোভিড যে বিপজ্জনক, তা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের যুক্তিজাল বোনা অদরকারি
আরও পড়ুন: সাংবাদিক শুনে সিট থেকে তুলে নিয়ে গেলেন পুলিশ অফিসার
কাকলির যাত্রা শুরুও কিন্তু ১৯৮৬ সাল থেকেই। গর্ভধারণের সমস্যায় ভুগতে থাকা মহিলার শরীরে ডিম্বাণু ঠিক মতো তৈরি হচ্ছে কি না, আকারে বাড়ছে কি না, পরিণত হচ্ছে কি না, তা বুঝে নিতে হয় আল্ট্রাসাউন্ড প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বারাসতের বর্তমান সাংসদ সে কাজে চৌখস সেই ১৯৮৬ সাল থেকেই। এতেই শেষ হয় না কাকলির চিকিৎসক পরিচয়। স্বামী সুদর্শনের মতো তিনিও কিন্তু স্বক্ষেত্রে পথিকৃৎ। ভারতে প্রথম থ্রি-ডি আলট্রাসাউন্ড মেশিন (উইথ ডপলার) আসে কাকলির হাত ধরেই। আইভিএফ প্রক্রিয়ার মোড় বেশ খানিকটা ঘুরিয়ে দেয় সে যন্ত্র।
কাকলি ঘোষ দস্তিদার। ফাইল চিত্র।
কাকলির সে কৃতিত্বের কথা আরও ভেঙে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন সুদর্শন। ‘‘যাঁরা কিছুতেই গর্ভধারণ করতে পারছেন না, তাঁদের আমরা একটা হরমোন ইঞ্জেকশন দিই। ঋতুচক্রের দ্বিতীয় দিন থেকে ইঞ্জেকশনটা দেওয়া শুরু হয়। একাধিক ভাল মানের ডিম্বাণু তৈরি করার জন্যই ওটা দিতে হয়। প্রয়োজন বুঝে পর পর ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত ইঞ্জেকশনটা দিতে হয়। আর আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে দেখে নিতে হয় যে, ডিম্বাণুটা পরিণত হল কি না। অতএব আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন যত উন্নত হবে, রেডিওলজিস্টরা তার ব্যবহার যত দক্ষ ভাবে করবেন, তত ভাল ভাবে ডিম্বাণু তৈরি করা যাবে,’’— বলে চলেন সুদর্শন। আর জানান, কাকলি ঘোষ দস্তিদার সেই কাজটাই অত্যন্ত দক্ষ হাতে সামলে আসছেন বছরের পর বছর। অক্সফোর্ড থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে বাবা-মায়ের ক্লিনিকে সম্প্রতি আবার যোগ দিয়েছেন ছেলে বিশ্বনাথ ঘোষ দস্তিদারও।
অন্য অনেক কিছুর মতোই গর্ভধারণে প্রতিবন্ধকতা কাটানোর এই চিকিৎসা নিজেই প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে লকডাউনের জেরে। ইঞ্জেকশন নেওয়ার জন্য টানা দিন দশেক ক্লিনিকে যাওয়া-আসা করা এখন বেশ কঠিন। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে গর্ভধারণ যাঁরা করতে পেরেছেন, তাঁদের প্রসবের সময় এসে গেলেও আর এক সমস্যা। সুদর্শন-কাকলির হাসপাতাল ভবানীপুরে। কিন্তু চিকিৎসাপ্রার্থী তো গোটা রাজ্যেই, এমনকি দেশের বাইরেও। বাংলাদেশ থেকেও বহু দম্পতি কলকাতায় আসেন সুদর্শন-কাকলির প্রতিষ্ঠানে। ট্রেন-বাস-ট্যাক্সিহীন সড়ক আর উড়ানহীন আকাশ তাঁদের জন্য কঠিন করে তুলেছে পরিস্থিতি। কাকলি ঘোষ দস্তিদারের কথায়, ‘‘ইঞ্জেকশন শুরু করা, ডিম্বাণু বার করে এনে তাকে নিষিক্ত করা, সেই নিষিক্ত ডিম্বাণুকে ফের গর্ভে প্রতিস্থাপন করা— সব মিলিয়ে ১৭-১৮ দিন সময় লাগে। প্রথম দিকটায় যাতায়াত করতে হয়। পরের দিকটায় সেন্টারে থাকতে হয়। ফলে যাঁদের বাড়ি কলকাতার বাইরে বা অনেক দূরের জেলায়, তাঁদের জন্য লকডাউন খুব বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।’’ সে বাধা কাটল কী ভাবে? কাকলি জানালেন, গড়িয়াহাটে তাঁদের যে পুরনো ক্লিনিক রয়েছে, সেখানে দূরের রোগীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনেই সে ব্যবস্থাপনা। থাকার জন্য কোনও আলাদা খরচও নেই।
যাঁদের ক্ষেত্রে প্রসবের সময়টা কাছাকাছি চলে এসেছিল, তাঁদের সমস্যাটা ছিল আরও বেশি। তাই কখনও ফোনে সমস্যা শুনে নিয়ে সমাধান বাতলেছেন সুদর্শন। কখনও আবার উত্তরবঙ্গে বা ঢাকায় থাকা কোনও সন্তানসম্ভবার জন্য স্থানীয় কোনও চিকিৎসকের সঙ্গে স্কাইপ কলে মিটিং করেছেন।
স্থানীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন কী ভাবে? হাসেন সুদর্শন। বলেন, ‘‘চল্লিশ বছর ধরে কাজ করছি। কাকলি ৩৫ বছর। আমাদের জুনিয়র বা আমাদের কাছে প্রশিক্ষিত হয়েছে, এমন চিকিৎসকের সংখ্যা কি কম!’’ সত্যিই, কম হওয়ার কথা নয়। অতএব সে নেটওয়ার্ক কাজে লেগেছে এই অবেলায়। লকডাউনে আর কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতায় আসার দরকার নেই, বলে দিয়েছেন কাকলি-সুদর্শন। ছড়িয়ে থাকা জুনিয়র বা সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোচবিহার থেকে মালদহ, মুর্শিদাবাদ থেকে বর্ধমান, প্রসব করিয়েছেন নানা জায়গায়।
এ ভাবেই নিরন্তর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন হাই-প্রোফাইল দম্পতি। সঙ্গে এখন ছেলেও। ৩ জনে মিলে অন্তত ৩০ দম্পতির স্বপ্ন সফল করেছেন এই দুর্যোগের মাঝেও। ‘‘সার্থকতা এতেই, রাজনীতিতেও নয়, টাকাপয়সাতেও নয়,’’— হেসে বলছেন ‘প্যাশনেট’ ডাক্তার সুদর্শন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy