(বাঁ দিকে) সে দিন গোলমালের ছবি। বুধবার সব শান্ত (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ইডি আধিকারিকদের ঘিরে ধরে ১৯ দিন আগে যেখানে চড়থাপ্পড়ের বন্যা বয়ে গিয়েছিল, বুধবার সকালে সেই জায়গাই বিলকুল ফাঁকা। কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেল না। কেউ কিছু দেখেননি। কেউ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিলেন। কেউ বাজারে গিয়েচিলেন। কেউ গিয়েছিলেন অন্য কোনও কাজে।
রকমসকম দেখে তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। যেখানে পাড়ার ছেলেরা এসে জানালা দিয়ে এক প্রবীণ শিক্ষককে বলে যেত, ‘‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।’’ আর নিজের চোখের সামনে কন্যার শ্লীলতাহানির ঘটনা দেখেও মুখ বুজে থাকতে হত তাঁকে। নইলে, তিনি কিছু দেখে ফেললে তাঁর কন্যার মুখে অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। প্রবীণ শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কন্যার ভূমিকায়, ঘটনাচক্রে, অধুনা তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়। যাঁর দলের নিখোঁজ নেতা শেখ শাহজাহান। যাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে ‘জনরোষ’-এর মুখে পড়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
৮০০ থেকে হাজার লোকের জনরোষ আছড়ে পড়া সেই সরবেড়িয়ায় বুধবার আবার গিয়েছিল ইডি। কিন্তু সেখানে অস্বাভাবিক নীরবতা। শাহজাহানের নামাঙ্কিত বাজারে দোকানপাট বন্ধ। কোনও এক ‘অজ্ঞাত’ কারণে রাস্তায়ও বিশেষ লোকজন নেই। বেলা ১২টা বাজলেও শীতের কাঁপুনি গায়ে মেখে মেঘলা সন্দেশখালির যেন ঘুমই ভাঙছে না। আরও আশ্চর্যের বিষয়, ১৯ দিন আগে যে ধুন্ধুমারের পরিণতিতে বুধবার রণসাজে সজ্জিত হয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারি, পুলিশে ছয়লাপ গোটা এলাকা, সেই ঘটনা ঘটতে নাকি দেখতেই পাননি শাহজাহানের গ্রামের বাসিন্দারা! ঘটনার দিন কেউ বাড়িতে ছিলেন না, কারও আবার ঘুম ভেঙেছে এতই দেরিতে যে, বাইরে বেরিয়ে শোনেন, সব শেষ। যদিও, টিভিতে দেখে যা বুঝেছেন তাতে সকলেই একমত, সে দিন যা হয়েছে, তা খুবই খারাপ হয়েছে!
গত ৫ জানুয়ারি সাতসকালে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ইডি সরবেড়িয়া গ্রামে শেখ শাহজাহানের বাড়িতে পৌঁছতেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। শাহজাহানের অনুগামীদের তাণ্ডবে সে দিন প্রাণ হাতে করে কলকাতা পালিয়ে আসতে হয়েছিল ইডির গোয়েন্দা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের। সে দিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে ইডির তাবড় কর্তারাও কেঁপে উঠেছিলেন। ইডির আহত আধিকারিকদের চিকিৎসা করাতে ভর্তি করানো হয়েছিল বেসরকারি হাসপাতালে। তার পর কেটে গিয়েছে ১৯টি দিন। আবার সেই সন্দেশখালির সরবেড়িয়ায় শাহজাহানের ডেরায় হাজির কেন্দ্রীয় এজেন্সির গোয়েন্দারা। কিন্তু সে দিনের সঙ্গে পার্থক্য হল, বুধবার সঙ্গে রয়েছে রণসাজে সজ্জিত শতাধিক কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান। পর্যাপ্ত সংখ্যায় রয়েছে রাজ্য পুলিশও। কিন্তু আরও একটি বড় পার্থক্য রয়েছে সে দিন আর বুধবারে। তা হল, গ্রামবাসীরা। আনন্দবাজার অনলাইনের প্রতিনিধির সঙ্গে বুধবার দেখা হয় এলাকারই অন্তত ২০ জনের। কথাও হয়। চুম্বকে যার নির্যাস, ১৯ দিন আগের ঘটনা শাহজাহানের পড়শিরা কেউ দেখতেই পাননি!
শাহজাহানের বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে দেখা গেল, কোলে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে এক বধূ। সামনেও দাঁড়িয়ে একটি শিশু। আমাদের প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে দু’কথা বলতেই, চায়ের নিমন্ত্রণ করে বসলেন। কিন্তু ঘটনার প্রসঙ্গ উঠতেই মুখে কুলুপ। তিনি বলছেন, ‘‘আমার বাচ্চাটির (কোলেরটিকে দেখিয়ে) শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম ওকে নিয়ে। ফিরে এসে শুনলাম এই কাণ্ড!’’
শাহজাহানের বাড়ির কাছেই কালভার্ট পেরিয়ে সরু ঢালাই রাস্তা চলে গিয়েছে গ্রামের ভিতরে। সেখানেই দাঁড়িয়েছিলেন আরও কয়েক জন মহিলা, পুরুষ। তাঁদের এক জন বললেন, ‘‘আমি তো সে দিন শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। তাই কিছুই দেখিনি। এখানে আমার বাপের বাড়ি। এখানেই থাকি। পরে টিভিতে দেখেছি।’’ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক মহিলা আবার বলছেন, ‘‘বাপের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এই গাঁয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি। টিভিতে দেখেছি সব।’’ সেখান থেকে একটু দূরে রাস্তায় বসে থাকা এক স্থানীয় বাসিন্দা বলছেন, ‘‘আমার বাড়িটা অনেক ভিতরের দিকে। গোলমাল যখন হচ্ছিল বাড়িতে বসে টিভিতেই সব দেখলাম। খুবই খারাপ হয়েছে। এ সব টিভিতে দেখে তো আমার মেয়েটার জ্বর চলে এসেছিল।’’ তাঁর সঙ্গে বসে থাকা অপর ব্যক্তির কথায়, ‘‘আমার তো ঘুম ভাঙে দেরিতে। যখন উঠলাম, তখন সব শেষ। পরে সবার কাছে শুনলাম, মোবাইলেও দেখলাম।’’
শাহজাহানের বাড়ির মুখোমুখি চলে গিয়েছে একটি গলি। সরু ঢালাই রাস্তা ধরে ভিতর দিকে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন জনা সাতেক মহিলা। তারই মধ্যে রয়েছেন বছর ৬৫-এর এক প্রৌঢ়া। তিনি বলছেন, ‘‘চোখে কম দেখি। কিছুই দেখতে পাইনি।’’ এর পরেই প্রৌঢ়ার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ধরা পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘শাহজাহান আমাদের সকলের মাথার মণি। তাই মন খুব খারাপ। ওঁকে নিয়ে এ রকম হচ্ছে দেখে অদ্ভুত লাগছে।’’ প্রৌঢ়াকে থামিয়ে পাশেই দাড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলে ওঠে, ‘‘দাদা খুবই ভাল। কারও দরকার হলেই সাহায্য করেন। কারও হয়তো টাকার প্রয়োজন, দাদাকে গিয়ে বললেই, পকেটে যা থাকবে, সব দিয়ে দেবেন।’’ সরবেড়িয়াতেই দোকান করেন এক মহিলা। তাঁর বয়ান অবশ্য ভিন্ন। গোলমাল যে হয়েছিল তা মুখে মানেননি তিনি। শুধু বলেছেন, ‘‘আজ ভাল বিক্রি হচ্ছে। পুলিশ, জওয়ানরা কেনাকাটা করছেন। ওই দিনও ভাল বিক্রি হয়েছিল।’’
সব মিলিয়ে সরবেড়িয়া গ্রামে গোটা সকাল ঘুরেও এক জনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না, যিনি ৫ জানুয়ারির গোলমাল নিজের চোখে দেখেছেন। মোটের উপর সকলেরই বক্তব্য, অকুস্থলে ছিলেন না। তাঁরা টিভিতে সব দেখেছেন। পাশাপাশি, আরও একটি বিষয়ে অবশ্য গ্রামবাসীরা একমত, সে দিন যা ঘটেছে, তা খুবই ভুল এবং অন্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy