সোমবার ওই হোগলাবন থেকে পাওয়া যায় একটি ট্রেনের টিকিট। ঘটনার দিন অর্থাৎ রবিবার দুপুর ২টো ৫০ মিনিটে বর্ধমানের মেমারি স্টেশন থেকে কাটা শ্যাওড়াফুলির রিটার্ন টিকিট। সেই টিকিটও খানিক বিভ্রান্ত করছে তদন্তকারীদের। কারণ, তদন্তে জানা গিয়েছে ধৃত আততায়ীর নাম শম্ভু পণ্ডিত। ওরফে অমিত। বাড়ি নদিয়ার হরিণঘাটায়। কিন্তু মেমারির সঙ্গে তা হলে শম্ভুর কী সংযোগ?
অনুপমের এই খুন হওয়ার কারণ নিয়ে এলাকায় নানা ধরনের জল্পনা চলছে। তার মধ্যে একটি হল— বড় একটি বাগানের প্রোমোটারি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
জিন্সের ভিতর থেকে এমন ভাবে আগ্নেয়াস্ত্রটা বার করেছিল, যেন সেটা ওয়ালেট। রাত তখন আটটা বাজতে কিছুটা বাকি। দোকান থেকে বেরিয়ে সবে স্কুটারের পিছনের আসনে বসেছেন অনুপম দত্ত। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে ওই আততায়ী অত্যন্ত ধীরেসুস্থে এসে তাঁর মাথার পিছন দিকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে। তার পরেই দৌড়। লহমায় স্কুটার থেকে লুটিয়ে পড়েন পানিহাটি পুরসভার কাউন্সিলর অনুপম। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়েই আততায়ীর পিছু নেন স্থানীয়েরা। তাঁদের উপস্থিতবুদ্ধির জোরেই আততায়ী এখন পুলিশের ডেরায়। জেরা চলছে। পুলিশের দাবি, সঠিক পথে এগোলেও তদন্ত এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। কিন্তু যে দ্রুততায় আততায়ী ধরা পড়েছে, তার কৃতিত্ব স্থানীয়দের।
আগরপাড়ার তেঁতুলতলা এলাকার রাস্তাটা একেবারেই চওড়া নয়। এক দিক থেকে রিকশা গেলে, উল্টো দিক থেকে আসা বাইককে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। এবড়োখেবড়োও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অনুপমকে গুলি করে সেই রাস্তা দিয়েই দৌড়েছিল আততায়ী। গুলির আওয়াজ শুনে আশপাশ থেকে লোকজনও দৌড়ে আসে। তাঁদের কয়েক জন অনুপমকে নিয়ে সাগর দত্ত হাসপাতালে যান। বাকিরা পিছু নেন আততায়ীর। এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, ‘‘৫০০ মিটার মতো দৌড়নোর পরেই আততায়ী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমরাও থমকে যাই। গেল কোথায় তুঁতে-নীল মোটা ডোরাকাটা টি-শার্ট পরা ছেলেটা? বুঝতে পারছিলাম না।’’ রাস্তার পাশেই দীর্ঘ দিনের পরিত্যক্ত জলাজমি। ঘন হোগলা গাছে ভরা। সাধারণত কেউ ওখানে ঢোকেই না। হোগলার সেই বনেই লুকিয়ে পড়েনি তো আততায়ী? স্থানীয়েরা তত ক্ষণে হোগলাবন ঘিরে ফেলেছেন। ওই প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, ‘‘ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎই এক জন বলে উঠলেন, ‘আগুন লাগিয়ে দিই চলো। শুকনো পাতা। পুড়ে যাবে। ভিতরে যদি কেউ লুকিয়ে থাকে, সে বেরিয়ে আসবে আগুনের ভয়ে।’ তার পরেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় হোগলাবনে।’’ দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে শুকনো পাতা। চার দিক জ্বলে উঠতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এক যুবক। কিন্তু তার গায়ে তুঁতে-নীল মোটা ডোরাকাটা টি-শার্ট তো নেই! তবে কি আরও কেউ আছে ভিতরে?
স্থানীয়দের দাবি, এর পর ওই জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও আর কাউকে পাওয়া যায়নি। তাঁদের ধারণা, জঙ্গলের ভিতর ঢুকেই জামা বদলে নিয়েছিল আততায়ী। তার কাছ থেকে একটি সিঙ্গল শটার উদ্ধার হয়েছে। তবে স্থানীয়দের অন্য একটা অংশ মনে করেন, ওই আততায়ীর সঙ্গে আরও এক বা একাধিক কেউ থাকতেই পারে। সে বা তারা হয়তো স্থানীয়ের ভিড়ে মিশে গিয়েছিল। তাই ধরা পড়েনি। সেই আততায়ীরা স্থানীয়ও হতে পারে। অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী বললেন, ‘‘আততায়ী স্থানীয় হলে চেনাজানাদের ভিড়ে মিশে যাওয়ার সুবিধা। সেটাই হয়তো হয়েছে। তবে যে ধরা পড়েছে, সে-ই গুলি চালিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু জামাটা অত দ্রুত বদলাল কী করে, সেটাই ভাবছি।’’ ওই যুববকে এর পর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
তত ক্ষণে পুলিশের হাতে এসে গিয়েছে, যেখানে অনুপম খুন হয়েছিলেন তার পাশের দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ। সেই ফুটেজে দেখা যায়, জিন্স আর তুঁতে-নীল মোটা ডোরাকাটা টি-শার্টপরা এক যুবক পিছন থেকে অনুপমকে গুলি করছে। আততায়ীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরেও স্থানীয়েরা ওই হোগলাবনে সোমবার তল্লাশি চানান। সেই সময় ওই হোগলাবন থেকে পাওয়া যায় একটি ট্রেনের টিকিট। ঘটনার দিন অর্থাৎ রবিবার দুপুর ২টো ৫০ মিনিটে বর্ধমানের মেমারি স্টেশন থেকে কাটা শ্যাওড়াফুলির রিটার্ন টিকিট। সেই টিকিটও খানিক বিভ্রান্ত করছে তদন্তকারীদের। কারণ, তদন্তে জানা গিয়েছে ধৃত আততায়ীর নাম শম্ভু পণ্ডিত। ওরফে অমিত। বাড়ি নদিয়ার হরিণঘাটায়। কিন্তু মেমারির সঙ্গে তা হলে শম্ভুর কী সংযোগ? স্থানীয়দের প্রশ্ন, তবে কি তাঁদের অনুমান মতো ওই যুবক বাদে হোগলাবনে আরও কেউ ছিল, যে মেমারি থেকে এসেছিল? স্থানীয়দের বক্তব্য, ওই হোগলাবনে বাইরের কেউ ঢোকে না। ফলে আততায়ীর কাছেই ওই টিকিট ছিল। না হলে একেবারে টাটকা কাটা টিকিট কী ভাবে ওই পরিত্যক্ত বনে আসবে!
তদন্তকারীরা যদিও এ সব প্রশ্ন নিয়ে কিছু বলতে নারাজ। তবে তাঁদের দাবি, সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পাওয়া আততায়ীকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘তদন্ত সঠিক পথেই চলছে। আততায়ীতে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সে সব এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’’ পরে যদিও এই তদন্তের দায়িত্ব সিআইডি-র হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এলাকাবাসীর দাবি, হোগলাবনের পাশের এক নর্দমা থেকে একটি ৯ এমএম পিস্তল পাওয়া যায়। হোগলাবনের ভিতরে মিলেছে একটু পুরনো মোবাইল ফোন। তার ভিতরে যদিও কোনও সিম ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীদের এক জনের কথায়, ‘‘তুঁতে-নীল মোটা ডোরাকাটা টি-শার্ট পরা আততায়ী যে ভাবে দৌড়চ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল এলাকার রাস্তাঘাট ভাল করে সে চিনত না। সেই কারণেই হোগলার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল।’’
অনুপমের এই খুন হওয়ার কারণ নিয়ে এলাকায় নানা ধরনের জল্পনা চলছে। তার মধ্যে একটি হল— বড় একটি বাগানের প্রোমোটারি। ওই জমিটিতে দীর্ঘ দিন ধরেই প্রোমোটারি করতে চাইছিলেন কেউ কেউ। তা নিয়ে বৈঠকও হয়েছে একাধিক বার। কিন্তু অনুপম তাতে খুব একটা রাজি ছিলেন না। স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘সোমবারও ওই বাগান নিয়ে একটা বৈঠক ছিল। সেখানে অনুপমদার উপস্থিত থাকার কথাও ছিল। তার আগেই তো ওকে মেরে ফেলা হল!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy