গ্রাহক সেবা কেন্দ্র। চোপড়া এলাকায়। ছবি: স্বরূপ সরকার।
“আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছিল ওরা। বলেছিল, চিকিৎসায় টাকা লাগে আমার। সেই টাকা ঢুকিয়ে দেবে,” বলছিলেন সেই বৃদ্ধ। চোপড়ার লালবাজারের ধারেই তাঁর গ্রাম। গ্রামের কাছে বাংলাদেশ সীমান্ত। বৃদ্ধ ভুগছেন ক্যানসারে। ওষুধের দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চে বসে চাপা স্বরে বলেন, “জীবনে ফাটকা খেলিনি। আজও ও পথ মাড়াব না। তাই তথ্য দিইনি। টাকাওপাইনি।” তার পরে বলেন, “আমার গ্রামে, অনেকের অ্যাকাউন্ট ভাড়ায় নিয়েছে ওরা।”
‘ওরা’ কারা? খোলসা করেন না বৃদ্ধ। বলেন, “দামি মোটরবাইক আর লক্ষ টাকার ফোন (আইফোন) নিয়ে যারা ঘুরত। গ্রাম এখন ফাঁকা। রাতারাতি অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। বাড়িতে-বাড়িতে বন্ধ হয়েছে কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট (সিএসপি) বা গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্র।”
পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন, লক্ষ্মীপুরের মহম্মদ জামালউদ্দিন, অর্থলগ্নি সংস্থার কর্মী। জানেন এ কথা? বললেন, “এ সব বেশি খোঁজ নেবেন না এই এলাকায়। বিপদ বাড়তে পারে।” পরে অবশ্য তিনিই দাবি করলেন, চোপড়ার বিভিন্ন এলাকায় ‘সিএসপি’র নাম করে অবৈধ অ্যাকাউন্ট ভাড়া নেওয়ার এই চক্র, জালিয়াতির কারবারের দৌলতে মনে পড়াতে পারে ঝাড়খণ্ডের জামতাড়াকে।
রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) সদস্যদের একাংশ একমত। তাদের অনুমান, ‘সিএসপি’-তে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড ফটোকপি করাতে গেলেই সে সবের অতিরিক্ত কপি রেখে দেওয়া হত। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চালু রাখার কাজে ব্যবহৃত আঙুলের ছাপের তথ্যও সরানো থাকত আলাদা করে। সামান্য এ দিক-এ দিক করে সে সব দিয়ে জাল অ্যাকাউন্ট খোলা, টাকা লেনদেন— সব হয়েছে। সে সব অ্যাকাউন্টে লেনদেনের সময়ে ‘ওটিপি’ (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) জানার কাজে ব্যবহৃত প্রচুর ‘সিমকার্ড’ উদ্ধারও হয়েছে।
পাশাপাশি, ‘ইচ্ছুকদের’ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য নিয়ে প্রতি লেনদেন পিছু ৪০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। একাধিক গ্রামে সে কাজে ব্যবহার করা হয়েছে মোটরবাইক চড়ে, মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ‘এজেন্টদের’। যাঁরা অ্যাকাউন্ট ‘ভাড়ায়’ দিয়েছেন, তাঁদের বলে দেওয়া হত, “কেউ জানতে চাইলে বলবি, মাটি কাটার টাকা, আত্মীয়ের পাঠানো টাকা বা সরকারি প্রকল্পের টাকা পেয়েছিস। এর বাইরে একটি কথাও নয়।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, “কিছু কিছু এলাকায় স্কুলের পাসওয়ার্ড, আইডি-ও বিক্রি হয়েছে। অনেককে বলতে শুনেছি, “স্কুলের তথ্য জোগাড় করে সিএসপি-তে দিতে পারলেই পয়সা মিলবে।” সরকারি ‘বাংলার শিক্ষা’ পোর্টালে লগ-ইন করে স্কুলের তথ্য তোলার জন্য যে পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল, অনেক স্কুলেই তা বদলানো হয়নি বলে খবর। সে পাসওয়ার্ড নিয়ে ‘ভাড়া’ নেওয়া অ্যাকাউন্ট বা জাল অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়েছে দুষ্কৃতীরা, দাবি তদন্তকারীদের। তাঁরা জানাচ্ছেন, দুষ্কৃতী-চক্রের অন্যতম চাঁই, স্থানীয় লক্ষ্মীপুর হাইস্কুলের পলাতক করণিক বাবুল হোসেন বা বাবর এমন ভাবেই ২০১৮ সালে হাতিয়েছিল সরকারি টাকা। কেরল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খাটে বাবুল।
রাজ্য জুড়ে ট্যাবের টাকা হাতানোর তদন্ত মাসখানেক হতে চলল। রাজ্য পুলিশ সূত্রের খবর, অন্তত ১৪০টি মামলার জেরে এখনও অবধি বন্ধ বা ‘ফ্রিজ়’ করা হয়েছে ১,২২০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৬৮ লক্ষ টাকা। প্রতিদিন মামলা ও উদ্ধার করা টাকার অঙ্ক বাড়ছে। সে মামলায় বাবরের পাশাপাশি, দিবাকর দাস, মোবারক হোসেনের মতো আরও অনেকে জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায়। এলাকাবাসীর কথায়, ‘ওরা’।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy