বিশ্বভারতী চত্বরে উত্তেজিত জনতা।
বিশ্বভারতীতে পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল তোলাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক গন্ডগোল, ভাঙচুর চালানো হল গোটা এলাকায়। তার জেরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্বভারতী বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রককে।
সোমবার সকালে মেলার মাঠ ঘেরার প্রতিবাদে এলাকার হাজারখানেক মানুষ ভাঙচুর চালান বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী অফিসে। ভাঙা হয় বিশ্বভারতীর একটি গেটও। জেসিবি দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় সদ্য শুরু হওয়া পাঁচিলের ভিতের অংশ। বিক্ষুদ্ধ জনতা স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সামনেই বন্ধ করে দেয় নির্মাণ কাজ। তবে রাজ্যপাল টুইট করে বিশ্বভারতীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানিয়েছেন টুইটে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আজকের ঘটনার পর অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্বভারতী বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তাই এ প্রসঙ্গে তিনি কোনও মন্তব্য করবেন না বলে আজ নবান্নে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আমি কোনও মন্তব্য করব না। তবে, রাজ্যপাল আমাকে ফোন করার পর আমি খোঁজ নিয়ে যা জেনেছি, ওখানে একটা নির্মাণকাজ চলছিল। সেখানে সেই কাজ চলার সময় কিছু বহিরাগত উপস্থিত ছিলেন। ছাত্ররা তার প্রতিবাদ জানায়। জেলাশসককে বলেছি, উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনে পড়ুয়া ও স্থানীয়দের নিয়ে বৈঠক করুন। আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে হবে।’’
একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ওই নির্মাণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদানের জন্য। আমি একটাই কথা বলব, বাংলার ঐতিহ্য যাতে নষ্ট না হয়, বিশ্বভারতীর গৌরব এবং ঐতিহ্য যাতে অটুট থাকে, তা আমাদের সকলের দেখা উচিত।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নির্মাণ মানেই তা সৌন্দর্য বাড়ায় এমনটা কিন্তু নয়।’’
এ সবের পর এ দিন ফের টুইট করেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। তিনি লেখেন, ‘‘বিশ্বভারতীতে তাণ্ডব ও ভাঙচুরের ঘটনা এবং তা রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সময় মতো পদক্ষেপ করতে ব্যর্থ হওয়ায় অত্যন্ত পীড়িত আমি। মুখ্যমন্ত্রীকে হিংসার বর্ণনা দিয়েছি। জানিয়েছি, পুলিশ এবং প্রশাসনকে ঘটনাস্থলে দেখাই যায়নি। সকলকে শান্তি বজায় রাখার আর্জি জানাচ্ছি।’’ তিনি আরও লেখেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ ভাইস চ্যান্সেলর কাউন্সিলের (ডব্লিউবিভিসিসি) সভাপতিকে আলোচনায় বসার আর্জি জানিয়েছি। ডব্লিউবিভিসিসির তরফে রাজ্যপাল তথা উপাচার্যকে কলঙ্কিত করার অহেতুক প্রচার অভিযান চালানো হয়েছে। উপাচার্যদের এ হেন আচরণ অত্যন্ত অশোভন। সমাজ এবং যুবসমাজের আদর্শ হয়ে ওঠা উচিত তাঁদের।’’
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সোমবার ভাঙচুর এবং তাণ্ডবের সময় পুলিশের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। সোমবার সন্ধ্যায় বিশ্বভারতীর সহকারী রেজিস্ট্রার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয়েছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের মধ্যেই রয়েছে দু’টি থানা। তার পরেও এ দিন গন্ডগোলের সময় কোনও পুলিশকর্মী উপস্থিত ছিলেন না।
এ দিনের তাণ্ডবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েক লক্ষ টাকার জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছে গোটা বিষয়টি আচার্য এবং শিক্ষা মন্ত্রকে জানানো হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ভর্তি এবং পরীক্ষার মতো জরুরি কাজকর্ম চলবে বলে জানানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এদিন জানানো হয়েছে, জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে এই পাঁচিল দেওয়ার কাজ করা হচ্ছিল। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটি সিএজির নিরাপত্তা বিষয়ক পরামর্শদাতা প্রাক্তন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের পরামর্শ অনুযায়ী নিরাপত্তার খাতিরে এই পাঁচিল দেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তাদের অভিযোগ গন্ডগোল হতে পারে আশঙ্কা থেকেই স্থানীয় মহকুমাশাসক, জেলাশাসক এবং জেলার পুলিশ সুপারকে কাজ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেই আবেদনে কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি রবিবার রাতে হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা এন বি এফ কর্মীদেরও প্রত্যাহার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে তান্ডব ভাংচুরে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার এবং করার শাস্তি দাবি করেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকেই ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।
পৌষমেলার মাঠ ঘেরা নিয়ে রবিবার থেকেই উত্তপ্ত শান্তিনিকেতন। এ বছর পৌষমেলা হবে না বলে আগেই জানিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার পর শনিবার থেকে শুরু হয় মেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়ার কাজ। মেলার মাঠ ঘেরার প্রতিবাদ করেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ। ‘মেলার মাঠ বাঁচাও, শান্তিনিকেতন বাঁচাও’ নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় পেজ তৈরি করে গত কয়েক দিন ধরেই শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ।
মেলার মাঠ ঘেরার কাজ শুরু হলে রবিবার স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতি বাধা দেয়। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ী সমিতি নির্মাণ কাজের ঠিকাদার এবং কর্মীদের মারধর করেছে। রবিবার মেলার মাঠ ঘেরার প্রতিবাদ করে মিছিলও বের করেন স্থানীয়রা। নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটি-র তরফে বোলপুর থানায় একটি এফআইআরও দায়ের করা হয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়, এই অতিমারি পরিস্থিতিতে যেখানে ৫০ জনের বেশি জমায়েতে প্রশাসনের বারণ রয়ছে, সেখানে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ২০০-৩০০ লোকের জমায়েত করে পাঁচিল তৈরির কাজ শুরু করেছেন।
চলছে ভাঙচুর।
আরও পড়ুন: এক সপ্তাহ পরেও স্থিতিশীল প্রণববাবু, রয়েছেন ভেন্টিলেশনে
সেমবার সকাল থেকে নির্মাণের কাজ শুরু হলে প্রতিবাদ করতে জমায়েত হন এলাকার বাসিন্দারা। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আশা মুখোপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেন সোমবার সকালে। উপাচার্য মিছিল করে মেলার মাঠে পৌঁছন সকাল ৯ টা নাগাদ এবং তাঁর উপস্থিতিতে পে লোডার দিয়ে শুরু হয় মেলার মাঠ ঘেরার জন্য নির্মাণের কাজ। সেই খবর পেয়েই সকাল ১০টা থেকে শান্তিনিকেতন-বোলপুর থেকে প্রচুর মানুষ জমা হন প্রতিবাদ করতে। এলাকায় মিছিল করেন দুবরাজপুরের তৃণমূল বিধায়ক নরেশ বাউরি।
ভেঙে ফেলা হয় বিশ্বভারতীর একটি গেটের স্তম্ভ।
সেই জমায়েত থেকেই শুরু হয় তাণ্ডব। উত্তেজিত জনতার একটি বড় অংশ নির্মাণ সামগ্রী লন্ডভন্ড করে দেন। তার পর এলোপাথাড়ি ভাঙচুর চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্প ভেঙে দেওয়া হয়। তার মধ্যেই নির্মা্ণের জন্য আনা পে লোডার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গেটের স্তম্ভ ভেঙে দেয় জনতার একাংশ। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গেটের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে ভিতরে। অভিযোগ, সেখানেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।
নির্মা্ণের জন্য আনা পে লোডার দিয়ে ভাঙা হয় গেটের স্তম্ভ।
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল এগরার বিধায়ক সমরেশ দাসের
বোলপুর ব্যবসায়ী সমিতির তরফে সুনীল সিংহ এ দিনের গন্ডগোলের সময় হাজির ছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বোলপুরে বসন্ত উৎসব এবং পৌষমেলা বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছেন। তাই এই মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিচ্ছেন ওঁরা। কিন্তু বোলপুরের মানুষ এ সব মেনে নেবে না। উপাচার্যের অরাজকতার বিরুদ্ধে বোলপুরের মানুষ এক হয়ে প্রতিবাদ করেছে। আমরা ওঁকে ভদ্র ভাবে বলেছিলাম। উপাচার্য সে সব শোনেননি। রবীন্দ্র ঐতিহ্য জড়িয়ে বোলপুরের সঙ্গে। উনি এখানকার সেই পরিবেশ নষ্ট করছেন।’’
এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর পাঠভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, ‘‘নিরাপত্তার জন্য অনেক জায়গায় পাঁচিল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, পৌষমেলার মাঠ কেন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমি এটা সমর্থন করি না। সারা বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র আদর্শ বিরোধী কাজকর্ম চলেছে৷ এখন কোথায় রবীন্দ্র আদর্শ অনুযায়ী কাজ হচ্ছে? কোথাও হচ্ছে না৷ রবীন্দ্র আদর্শের কথা না বলাই ভাল৷’’
পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়ার নিয়ে ক্ষুব্ধ পর্তমান পড়ুয়ারাও। এক পড়ুয়ার কথায়, ‘‘আমরা উপাচার্যের কাছে আবেদন করেছি, পৌষমেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে না ঘোরার জন্য। আবেদন না মানলে বৃহত্তর আন্দোলনে নামব।’’
গোটা ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। তিনি টুইট করে বিশ্বভারতীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান। প্রথম টুইটের আধ ঘণ্টা পরে ফের তিনি টুইট করে জানান, বিশ্বভারতীর বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy