তৃণমূলের একুশের জনসভা। নিজস্ব চিত্র।
বেলা ১২টা ১০ মিনিট। এস এন ব্যানার্জি রোড ধরে একটি ট্যাবলো নিয়ে ডোরিনা ক্রসিংয়ের দিকে এগোচ্ছে কলকাতা পুরসভার ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড তৃণমূল কংগ্রেসের মিছিল। মিছিলের সামনে থাকা পুলিশ কর্মীরা উল্টোদিক থেকে আসা জনস্রোত ঠেলে হিমশিম খাচ্ছেন মিছিল এগিয়ে নিয়ে যেতে। মঞ্চের বিপরীতগামী সেই জনস্রোত বাঁধ মানেনি খোদ দলনেত্রী মঞ্চে বলতে শুরু করার পরও।
সেই জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে হতাশ চোখে জিনিসপত্র গোটানোর তোড়জোড় করছিলেন মানব অধিকারী। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছর শহীদ দিবসে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া বিভিন্ন ধরণের স্মারক, ব্যাজ, ছবি বিক্রি করেন মানব। নিউ ব্যারাকপুর থেকে রবিবার কার্যত সাতসকালেই এস এন ব্যানার্জি রোডের মুখে প্লাস্টিকে মালপত্র ঢেলে বিক্রিবাটা করার জন্য বসে আছেন মানব। মানব তাঁর গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘‘ধুস, এবারে লোকজনও নেই, বিক্রিও নেই। সকাল থেকে একটা বড় মিছিল পর্যন্ত নেই। অন্যবার আটটা থেকে লোকজন ভিড় করে।’’ মানবের দাবি, গত বছরও তাঁর বিক্রি হয়েছিল প্রায় তিন হাজার টাকার। এবার ৮০০ টাকারও ব্যবসা হয়নি। মঞ্চে তখন দলনেত্রীর বক্তব্য মাঝপথে।
এস এন ব্যানার্জি রোড-জওহরলাল নেহেরু রোডের সংযোগস্থলে জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে ছাড়া ডোরিনা মোড় বা এসএন ব্যানার্জি রোডে ভিড় খাপছাড়া। এমনকি, লেনিন সরণির মুখের অংশ ছাড়া বাকিটা ফাঁকা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য চলাকালীন। ম্যাডান স্ট্রিট-সেন্ট্রাল অ্যাভনিউ সংযোগস্থল থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। নিজস্ব চিত্র।
চাকদহের বিষ্ণু দে শহিদ দিবসে আসছেন গত ১৫ বছর ধরে। লেনিন সরণির ধারে একটা দোকানের ছায়ায় বসে স্বীকার করেন, ‘‘এবার ভিড়টা একটু কম লাগছে।’’ ২০০৯-২০১০ সালের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘‘পার্ক স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত ভিড় চলে গিয়েছিল। আমরা ভোর বেলায় পৌঁছে কোনও মতে ডোরিনার কাছে জায়গা পেয়েছিলাম।’’ বিষ্ণুর মতোই তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে ২১ জুলাই ধর্মতলায় আসেন টালার প্রদীপ দাস। একেক বার একেক সাজে। ভিড় নিয়ে প্রশ্ন করতে প্রথমে কিছু না বলতে চাইলেও শেষে তিনি বলেন, ‘‘২১ জুলাই ১২টার সময় বাইক নিয়ে এস এন ব্যানার্জি রোড হয়ে মোতি শীল লেন ধরে লেনিন সরণি পেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পৌঁছতে পেরেছি এটা অভাবনীয়।’’ কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের এক কর্তাও বলেন, অন্য বারের তুলনায় এ বার ট্রাফিক অনেক মসৃণ চলেছে। সমাবেশ স্থলের আশেপাশের নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া বাকি শহরে যান চলাচল ছিল মোটের উপর স্বাভাবিক। তার একটা কারণ, রবিবার হওয়ায় যান বাহনের সংখ্যা কম। তবে ব্র্যাবোর্ন রোডের মত রাস্তাতেও মিছিলের সময় ছাড়া যান চলাচল করেছে মসৃণ ভাবে।
আরও পড়ুন: ‘কাটমানি’ রুখতে পাল্টা স্লোগান ‘ব্ল্যাকমানি’ ফেরত দাও! ব্যালট ফেরানোর দাবিতেও সরব মমতা
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতেও জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে ছাড়া ভিড়টা ম্যাডান স্ট্রিট পেরোয়নি। তাই বেলা ১১টার সময়ও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-গণেশ অ্যাউিনিউ সংযোগস্থল দিয়ে যান চলাচল করেছে মসৃণ ভাবেই।
ট্যাবলো ঘিরে সেল্ফির ভিড়। নিজস্ব চিত্র।
বর্ধমানের মেমারি থেকে এসেছেন টোটন হালদার। নিজেই বলেন যে তাঁর বয়স ৩৩। বাবার হাত ধরে কিশোর বয়স থেকে ২১ জুলাইতে আসেন প্রতিবার। পেশায় ১০০ দিনের কাজের সুপারভাইজার। তিনি দাবি করেন, তাঁর এলাকায় সরকারি কোনও প্রকল্প ঘিরে কোনও দুর্নীতি নেই। তবে এটাও মেনে নেন, ‘‘অনেক জায়গায় প্রচুর চুরি হয়েছে। তার জন্য তো ক্ষতি হচ্ছে। চোরদের ধরা গেলে আবার দলটা বাঁচবে।’’ মঞ্চে তখন মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করছেন যে বিজেপি পরিকল্পনা করে অনেক ট্রেন বাতিল করেছে। তাই অনেক তৃণমূল কর্মী এ দিন এসে পৌঁছতে পারেননি। বিষ্ণু, টোটন হাসনাবাদ থেকে আসা প্রতুল গায়েন ট্রেন নিয়ে কোনও অভিযোগ করেননি। রাস্তায় কোথাও বাস আটকানোর অভিযোগও করেননি। পূর্ব রেল এবং দক্ষিণ পূর্ব রেলও জানিয়েছে কোনও ট্রেন বাতিল করা হয়নি।
প্রতুল বলেন, ‘‘আমরা জন্ম থেকে দিদির সঙ্গে। তবে অনেকেই এখন হাওয়া মাপছে। তাদের ভিড়টা এবারে নেই।’’ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘বাস বা গাড়ি অন্যবারের মতোই এসেছে। তবে গাড়ি প্রতি কর্মীর সংখ্যা কম। সেই সঙ্গে উত্তর বঙ্গের তৃণমূল কর্মীদের যে বড় একটা ভিড় থাকে সেটা এবার নেই।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তরবঙ্গের এক নেতা স্বীকার করেন যে, মালদহ থেকে আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত সাতটি জেলা থেকে কর্মী অন্য বারের থেকে কম গিয়েছেন। তবে তিনি তার জন্য বিজেপির প্রভাব নয়, বন্যাকে দায়ী করেছেন। তবে উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি যে দক্ষিণ বঙ্গ থেকে জমায়েতে আগের থেকে ঘাটতি রয়েছে তা বোঝা যায় দ্বিতীয় হুগলি সেতু এবং ধূলাগড় টোল প্লাজার কর্মীদের কথায়। তাঁদের একজন বলেন, ‘‘অন্যবারের থেকে এবার কম গাড়ি গিয়েছে।’’
আরও পড়ুন: চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!
তবে দেগঙ্গার বছর সত্তরের মহম্মদ সাদিকের অবস্থাটা একটু ভিন্ন। ২০১১ সালের পর এ বার তিনি এলেন ২১ জুলাই ধর্মতলাতে। তিনি বলেন, ‘‘ সে বার ব্রিগেডে এসেছিলাম। এর পর অনেক দিন আসিনি। কিন্তু এবার এলাকায় ইমাম সাহেব থেকে সবাই বলছে বিজেপি এলে আমাদের বিপদ। তাই আমাদের এলাকা থেকে অন্য বারের থেকে অনেক বেশি মানুষ ধর্মতলায় এসেছেন।’’
সাদিকের দুশ্চিন্তা তাঁকে টেনে আনলেও, তৃণমূলের বাকি কর্মীদের একটা বড় অংশের মধ্যে যে ‘জল মাপা’-র প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা রবিবারের সভার পর অস্বীকার করছেন না তৃণমূলের অনেক জেলা নেতাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy