গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
সম্পর্কের আড়ষ্টতা কাটতে থাকার ইঙ্গিত আগেই মিলেছিল। এ বার মুছে গেল ঘোষিত ভাবে হাত ধরার ছুৎমার্গও। উপলক্ষ তিন বিধানসভা আসনের উপনির্বাচন। সৌজন্যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দশা।
কটাক্ষ অবশ্য তাতেও থামছে না। উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোটবদ্ধ লড়াইয়ের ঘোষণা সম্পর্কে রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য— একসঙ্গে মরারও একটা আনন্দ রয়েছে।
বুধবার বৈঠকটা বসেছিল ক্রান্তি প্রেসে। রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান তথা এ রাজ্যের প্রবীণতম রাজনৈতিক নেতাদের অন্যতম বিমান বসু ছিলেন পৌরোহিত্যে। সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র, রবীন দেব, সিপিআইয়ের স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন চট্টোপাধ্যায়, হাফিজ আলম সৈরানি বা আরএসপির ক্ষিতি গোস্বামী, মনোজ ভট্টাচার্যরা তো ছিলেনই। বিরল ছবি তৈরি করে বিমান বসুর ঠিক পরের দুটো চেয়ারে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র এবং কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য। সোমেনের ঠিক মুখোমুখি সূর্যকান্ত।
বাম ও কংগ্রেস বৈঠক। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে কি ‘পওয়ার প্লে’? ৬৩ বিধায়ক নিয়ে রাজভবনে আদিত্য, তুঙ্গে জল্পনা
লড়াই যখন তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে দ্বিমেরুকৃত হয়ে যাওয়ার পথে, তখন বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের যে কাছাকাছি আসা উচিত নিজেদের স্বার্থেই, সে কথা বোঝার পরে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা ইতিমধ্যেই কয়েক বার হয়ে গিয়েছে। সোমেনের আমন্ত্রণে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে হাজির হতে দেখা গিয়েছে বিমান-সহ বামফ্রন্ট শীর্ষনেতাদের, হৃদ্যতার ফোটোফ্রেম তৈরি হয়েছে। সে অবশ্য ছিল মহাত্মা গাঁধীর জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে। নির্বাচনী আসন সমঝোতার লক্ষ্যে কোনও বামপন্থী প্রকাশনার দফতরে ঘোষিত বৈঠকে বসছেন বাম ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ— এমন ছবি বাংলায় বেশ বেনজির। কিন্তু সেই বেনজির কাণ্ডটাই ঘটিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বাম-কংগ্রেসের নেতারা। কোনও টানাপড়েন ছাড়াই আসন সমঝোতাও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে।
যে ৩ আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে, তার মধ্যে উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ ছিল কংগ্রেসেরই দখলে। কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী প্রমথনাথ রায়ের প্রয়াণে ওই আসন খালি হয়েছে। আর পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর সদর আসন প্রায় পাঁচ দশক ধরে পরিচিত ছিল কংগ্রেসের গড় হিসেবে। চাচা মিথ ভাঙেন ২০১৪ সালে, বিজেপির দিলীপ ঘোষ জেতেন সেখানে। দ্বিতীয় স্থানে অবশ্য কংগ্রেসেই চাচা অর্থাৎ জ্ঞান সিংহ সোহনপালই ছিলেন। ওই ২ আসনই এ বারও কংগ্রেসকেই ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে বুধবারের বৈঠকে কোনও আপত্তি তোলেননি বাম নেতারা। আর নদিয়ার করিমপুর আসন বামেদের তথা সিপিএমকে ছাড়ার বিষয়ে সোমেন-প্রদীপও কোনও আপত্তি জানাননি।
অতএব আজ, বৃহস্পতিবার বামফ্রন্ট ঘোষণা করেছে, করিমপুরে সিপিএমের প্রতীকে লড়বেন গোলাম রাব্বি। আর এ দিন বিকেলেই প্রদেশ কংগ্রেসের নির্বাচনী কমিটি বৈঠকে বসে স্থির করেছে— খড়্গপুর সদরে লড়বেন এলাকার অত্যন্ত পরিচিত নেতা চিত্তরঞ্জন মণ্ডল, কালিয়াগঞ্জে লড়বেন প্রয়াত কংগ্রেস বিধায়কের মেয়ে। নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা এআইসিসি-কে জানিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস। সেখান থেকেই চূড়ান্ত সিলমোহর পড়বে প্রার্থীপদে।
আরও পড়ুন: ‘ভাগো ইহা সে… ভাগো’, কাশ্মীরের আতঙ্ক বসিরুলের মনের গভীরে
যতটা মসৃণ ভাবে এবং দ্রুত এই গোটা প্রক্রিয়াটা সেরে ফেলেছেন বামফ্রন্ট এবং প্রদেশ কংগ্রেসের নেতারা, ততটা সহজে কিন্তু না-ও হতে পারত। ২০১৬ সালে কিন্তু এতটা সহজে হয়নি। সে বার বাম-কংগ্রেসের পালে হাওয়া এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তা-ও মন খুলে কাছাকাছি আসতে দ্বিধায় ছিল বহু দশকের দুই যুযুধান। শেষ পর্যন্ত পরস্পরের জন্য অনেক আসনই ছেড়ে রেখেছিল দু’পক্ষই। কিন্তু কোনও সমঝোতার কথা লিখিত ভাবে স্বীকার করায় বামেদের অনেক দ্বিধা ছিল। সিপিএম যদিও বা বেশ কিছুটা বাস্তববাদী লাইন নিয়েছিল, আরএসপি-ফরওয়ার্ড ব্লক ঘোর বিরোধিতা করেছিল সমঝোতার। বেশ কিছু আসনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়ে দিয়েছিল তারা। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে আরও খারাপ হয়েছিল পরিস্থিতি। হাতে গোনা কয়েকটা আসন ছাড়া কোথাও সমঝোতায় যেতেই পারেনি বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস। ফলে এ বারের উপনির্বাচনেও সেই ছবিরই পুনরাবৃত্তি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তা হতে দিলেন না বিমান-সোমেনরা। ছুৎমার্গ দূরে রেখে প্রথাগত বৈঠক করলেন, সমঝোতা সূত্রে পৌঁছলেন, তার পরে প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করলেন।
কালিয়াগঞ্জ কংগ্রেসের হাতে দীর্ঘ দিন ছিল ঠিকই। কালিয়াগঞ্জ যে প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বাড়ির উঠোন, সে কথাও ঠিক। কিন্তু এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সেই কালিয়াগঞ্জে বামেদের চেয়ে এক হাজারের মতো ভোট কম পেয়েছে কংগ্রেস। অন্য দিকে করিমপুরে বামেদের চেয়ে হাজার পাঁচেক ভোট এই লোকসভা নির্বাচনে বেশি পেয়েছে কংগ্রেস। তাই ওই দুই আসন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছনো জটিল হতেই পারত বলে কংগ্রেসের একাংশের মত। কিন্তু বুধবারের বৈঠকে ঐকমত্যে পৌঁছতে কোনও সমস্যা হয়নি বলেই খবর।
তৃণমূলও এ দিন প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। খড়্গপুর সদরে প্রার্থী করা হয়েছে স্থানীয় পুরসভার চেয়ারম্যান প্রদীপ সরকারকে। লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুরের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ খড়্গপুর সদর থেকে প্রায় ৪৫ হাজারের লিড পেয়েছিলেন। কিন্তু বিধানসভার উপনির্বাচন তার পরেও টানটান হয়ে উঠতে চলেছে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক শিবিরের মত। খড়্গপুর পুরসভার চেয়ারম্যানকে তৃণমূল মাঠে নামানোয় বিজেপির লড়াই কঠিন হতে চলেছে বলে রেল শহরের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দাবি।
আরও পড়ুন: ভারতীয় সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে আড়ি! ব্যাখ্যা চাইল কেন্দ্র
করিমপুরে তৃণমূল টিকিট দিচ্ছে বিমলেন্দু সিংহরায়কে। নদিয়ার এই আসনে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের লিড ছিল ১৭ হাজারের আশেপাশে। উপনির্বাচনে তা আরও বাড়বে বলে তৃণমূলের বিশ্বাস। করিমপুর নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব উদ্বিগ্নও নন। তবে মুখে না বললেও, কালিয়াগঞ্জ নিয়ে যে আশা কম, তা উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের নেতাদের হাবেভাবে বেশ স্পষ্ট। লোকসভা নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে কালিয়াগঞ্জে তৃণমূল-বাম-কংগ্রেসের ভোট মিলিয়ে দিলেও বিজেপির ধারেকাছে পৌঁছচ্ছে না। তবে ওই আসনেও স্থানীয় প্রার্থী তপন দেবসিংহের উপরে ভরসা রেখেছে তৃণমূল। কয়েক দিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হওয়া বৈঠকে যে তিনটি নাম পেশ করেছিলেন উত্তর দিনাজপুরের তৃণমূল নেতারা, তাঁদের মধ্যে থেকেই তপন দেবসিংহকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে রাজ্যের শাসক দল সূত্রের খবর।
লড়াই কোন আসনে কেমন হতে চলেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের সংশয় কমই। তৃণমূলের প্রবীণ নেতা তথা রাজ্য মন্ত্রিসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমের সামনেই স্বীকার করছেন যে, কোন আসনে কী ফলাফল হতে পারে, তা আগে থেকেই অনেকটা বোঝা যাচ্ছে। সুব্রত বলছেন, ‘‘তিনটেই জিততে পারি। না পারলেও কিছু তো পাবই।’’ সুব্রতর কথার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ করিমপুরে তৃণমূলের অবশ্যম্ভাবী জয়ের বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সংশয় কমই। বাকি দুটো আসনে ফল যে দিকেই যাক, বাম-কংগ্রেস জোটের অনুকূলে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy