লতা মঙ্গেশকর। —ফাইল চিত্র।
বাংলা গান গাইতে হলে বাংলা শিখতে হবে। তাই তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও বাড়িতে শিক্ষক রেখে বাংলা শেখা শুরু করেন লতা মঙ্গেশকর। শিক্ষকের নাম বাসু ভট্টাচার্য। শুধু বাংলাই নয়, অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রেও তাঁর ভাবনাপথ একই। যেমন, সেকালের হিন্দি গানে উর্দু শব্দের প্রাবল্য ছিল বলে ছবির গানে পা রাখার প্রথম অধ্যায়েই শিখে নিয়েছিলেন উর্দু। স্কুলে গিয়েছেন জীবনে দু’দিন। কিন্তু জীবনভর শিক্ষানবিশ থেকে গিয়েছেন উপমহাদেশের সঙ্গীত-দুনিয়ার চিরপ্রণম্য শিক্ষক লতা মঙ্গেশকর।
বাংলার প্রতি তাঁর টান একটু বেশিই ছিল। বার বার বলেছেন সে-কথা। লিখেও গিয়েছেন। মনে করতেন, মরাঠি আর বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত মিল রয়েছে। বাংলার সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন নানা ভাবে। তাঁর বাবার ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী লতা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রিয়তম লেখক। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর পাথেয়। সুস্পষ্ট ও ঝরঝরে বাংলা উচ্চারণেই তিনি বলতেন— ‘বাংলা ভাষা খুব প্রিয়, কিন্তু শিখেও আমি বলতে পারি না!’
বাঙালিরও খুব প্রিয় আত্মীয় লতা মঙ্গেশকর। হেমন্ত যখন তাঁকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াচ্ছেন, তখন তাঁর ‘হেমন্তদা’র কাছ থেকে বুঝে নিচ্ছেন সে-গানের মর্মার্থ, অনুষঙ্গ এবং ইতিহাস। শচীনদেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রাহুলদেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পারিবারিক। হেমন্তের স্ত্রীকে সাধ খাওয়াচ্ছেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে আড্ডা মারছেন, ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে ‘বন্দেমাতরম্’ গাওয়ার জন্য কত টাকা লাগবে জানতে চাওয়ায় হেমন্তকে বলছেন, ‘টাকার জন্য নয়, আপনি বলেছেন বলে গাইছি।’
আমবাঙালি লতা মঙ্গেশকরের পরিজন হয়ে উঠেছে তাঁর বাংলা গানের মায়ায়। বাংলা বেসিক গানের প্রচুর রেকর্ড করেছেন লতা। বাংলার বহু সুরকারের সুরে গেয়েছেন। পাশাপাশি গেয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের জন্যও। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘প্রেম এক বারই এসেছিল নীরবে’, সলিল চৌধুরীর কথা-সুরে ‘না যেও না’র মতো অবিস্মরণীয় সব বাংলা গান রেখে গিয়েছেন লতা। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর গাওয়া ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে’ বাঙালির স্মৃতির কুয়াশা-আস্তরে জেগে থাকা আকাশপ্রদীপই। কিশোরকুমারের সুরে লতার ‘ভালবাসার আগুন জ্বেলে কেন চলে যাও’ বা লতার সুরে কিশোরকুমারের গাওয়া ‘আমি নেই’, ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’ গানপাগল বাঙালির আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখা সম্পদ। মুকুল দত্তের কথা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ১৯৬৬ সালের ‘মণিহার’ ছবিতে লতা-হেমন্তের ‘কে যেন গো ডেকেছে আমায়’ বা ১৯৬৯-এ ‘মন নিয়ে’ ছবিতে মুকুল দত্তের কথা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’ আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে কোহিনুর।
রবীন্দ্রনাথের গানেও তিনি বাঙালির হৃদয় জয় করেছেন। শুরু ‘মধুগন্ধে ভরা’ দিয়ে (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে)। গেয়েছেন ‘তোমার হল শুরু’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ (‘বউ ঠাকুরানির হাট’), ‘হৃদয় আমার নাচে রে’ (‘বউ ঠাকুরানির হাট’), ‘সখি, ভাবনা কাহারে বলে’ (‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে), ‘তুমি রবে নীরবে’ (কুহেলি’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে)।
বাংলা গানের ইতিহাসেও লতা মঙ্গেশকর এক চিরকালীন অধ্যায়, যার নির্বাপণ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy