Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Buddhadeb Bhattacharjee

৫ বছরের ফারাক, গাড়িতে চেপেই অভিবাদন গ্রহণ বুদ্ধদেবের, এ বার কানে গেল না ‘ইন্টারন্যাশনাল’

ব্রিগেডে জনসভায় বুদ্ধদেবের শেষ বক্তৃতা ২০১৫ সালের এপ্রিলে। সিপিএমের প্লেনাম উপলক্ষে ওই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন বুদ্ধদেব। যে সভা থেকে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘‘সামনে লড়াই, তৈরি হও।’’

Last mass appearance in 2019 & the last rite of Buddhadeb Bhattacharjee in 2014 dgtls

জনতার মধ্যে শেষ দুই সফর। জীবিত এবং প্রয়াত বুদ্ধদেবের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ২০:৫৪
Share: Save:

সে দিন সবটা শুনেছিলেন। এ দিন শুনতে পেলেন না। সে দিন ফিরে গিয়েছিলেন বাড়িতে। এ দিন চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।

ব্যবধান সাড়ে পাঁচ বছর। ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, রবিবার। সে দিন ছিল সিপিএমের ব্রিগেড সমাবেশ। দুপুর ২টো নাগাদ সাদা অ্যাম্বাসাডর এসে দাঁড়িয়েছিল মঞ্চের নীচে। গাড়ির পিছনের আসনের বাঁ দিকে বসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নাকে অক্সিজেনের নল। গালে খোঁচা খোঁচা না-কামানো দাড়ি। পাশে স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য।

মঞ্চ থেকে বিমান বসু ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, পার্টির নেতা কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।’’ উদ্বেল হয়েছিল মাঠ। করতালিতে ফেটে পড়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড। গাড়িতে বসে, অক্সিজেনের নল নাকে সেই অভিবাদন গ্রহণ করেছিলেন বুদ্ধদেব।

২০২৪-এর ৯ অগস্ট। মাঝে সাড়ে পাঁচ বছর তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি (বার দুয়েক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া-আসার সময় ছাড়া)। শুক্রবার বুদ্ধদেব গণ অভিবাদন গ্রহণ করলেন সেই গাড়ির ভিতর থেকেই। তবে শায়িত অবস্থায়। শুনতে পেলেন না কিছু। কানে গেল না ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ সঙ্গীত। শুনতে পেলেন না তাঁকে নিয়ে স্লোগান। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে গেল গণস্রোত। সেই স্রোতের মধ্যেই এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশে এগিয়ে গেলেন শববাহী শকটে শায়িত বুদ্ধদেব।

ব্রিগেডের সমাবেশে বুদ্ধদেব সে দিন পৌঁছতে পারবেন কি না, তা দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্তও নিশ্চিত ছিল না। সিপিএম নেতারা বারংবার ফোন করছিলেন পাম অ্যাভিনিউয়ে। বুদ্ধদেবের শরীরের খবর জানাচ্ছিলেন মীরা। সাধারণত স্নানের পরেই বুদ্ধদেবের শ্বাসকষ্ট বাড়ত। ঘটনাচক্রে, সে দিন তেমন ‘বাড়াবাড়ি’ হয়নি। নিজেই মীরাকে বলেছিলেন, ‘‘আমি পারব। আমি যাব।’’ সেই মতো এক নেতাকে মীরা ফোনে জানান, বুদ্ধদেব ব্রিগেডে যাচ্ছেন। কিন্তু গাড়ি থেকে নামবেন না। কারণ, ধুলোয় হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা। নামেননি। সে দিন ব্রিগেডে মঞ্চে না থেকেও বুদ্ধদেব বুঝিয়েছিলেন, তিনিই ‘শেষ জননেতা’।

শুক্রবার বেলা ৩টে ৪২ মিনিটে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে বুদ্ধদেবের গাড়ি যখন বাঁ দিকে শিয়ালদহের দিকে বাঁক নিল, সেই সময়ে মুঠো মুঠো ফুল উড়ে এসে পড়ছিল গাড়ির উপর। আর রাস্তার ধারে বাঁধা মঞ্চ থেকে দলের এক নেত্রী প্রায় ধরে আসা গলায় ঘোষণা করছিলেন, ‘‘আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে শেষ বারের মতো বেরিয়ে যাচ্ছেন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আপনারা সুশৃঙ্খল ভাবে রাস্তাটা ফাঁকা করে দিন।’’ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যে আলিমুদ্দিনে তিনি রোজ দু’বেলা যেতেন। সকালে মহাকরণ যাওয়ার আগে থাকতেন ঘণ্টা দেড়েক। দুপুরে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে ফিরতেন মধ্যাহ্নভোজ সারতে। দুপুরে খেয়ে সামান্য বিশ্রাম। তার পর আবার মহাকরণ। বিকেলে বেরিয়ে ফের ঘণ্টা তিনেক পার্টির রাজ্য দফতর আলিমুদ্দিনে। সরকারি ছুটির দিনে দু’বেলা যেতেন সেখানে।

ব্রিগেডে জনসভায় বুদ্ধদেবের শেষ বক্তৃতা ২০১৫ সালের এপ্রিলে। সিপিএমের প্লেনাম উপলক্ষে ওই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন তিনি। যে সভা থেকে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘সামনে লড়াই, তৈরি হও’। তার পরের বছরই ছিল বিধানসভা ভোট। শুক্রবার দেখা গেল বুদ্ধদেবের ওই উক্তি প্রকাণ্ড ব্যানারে ছাপিয়ে এনেছেন সিপিএমের ছাত্র-যুবরা। ২০১৭ থেকেই গৃহবন্দিজীবন শুরু হয়েছিল বুদ্ধদেবের। দৃষ্টিও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। অনেকে বলেন, শেষ কয়েক বছর প্রায়ান্ধ হয়েই দিন কেটেছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। কিন্তু এ সবের মধ্যেও দু’টি উপন্যাস লিখেছিলেন। একটি ‘নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’, অন্যটি চিন বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে ‘স্বর্গের নীচে মহাবিশৃঙ্খলা’। যে বই দেদার বিকিয়েছিল বামজনতার মধ্যে। ভাল বাণিজ্যও করেছিল সিপিএমের প্রকাশনা সংস্থা ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’।

Last mass appearance in 2019 & the last rite of Buddhadeb Bhattacharjee in 2014

শুক্রবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রায়। —নিজস্ব চিত্র।

বামফ্রন্ট সরকার চলে যাওয়ার পরে বুদ্ধদেব আগ্রহী হয়েছিলেন একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে। সেটি ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কেন জাপানি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তৎকালীন এক ছাত্রনেতাকে ওই বিষয়ে বই এবং গবেষণাপত্র জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন বুদ্ধদেব। তিনি তা করেও দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, বুদ্ধদেবের শেষযাত্রা হল ৯ অগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪৫ সালের এই দিনেই জাপানের নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। যার অভিঘাত চলেছিল কয়েক দশক ধরে।

গণবিস্ফোরণে শেষ বিদায় নিলেন বুদ্ধদেব। যাঁর শববাহী গাড়ির কাচ ধরে এক তরুণ রাস্তার পাশে দাঁড়ানো জনতার উদ্দেশে বলতে বলতে যাচ্ছিলেন, ‘‘শেষ বারের মতো জননেতাকে দেখে নিন! দেখে নিন শেষ বারের মতো জননেতাকে!’’

বুদ্ধদেব শুনতে পাচ্ছিলেন না। শুনতে পাচ্ছিলেন না বুদ্ধদেব।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy