বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যত বার রায় শুনিয়েছেন, তত বার তাঁর গলায় শোনা গিয়েছে আবেগ। কখনও ক্ষোভ। কখনও সমবেদনা। কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষ দিনেও সেই আবেগ, বেদনা আর ক্ষোভের মিশ্রণের সাক্ষী রইল তাঁর এজলাস থেকে চেম্বার। ‘ঈশ্বর’-কে বিদায় জানাতে বীরভূম থেকে ছুটে এলেন মহিলা। এজলাসেই কেউ আবার তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে চাইলেন। কেউ বললেন, ‘‘আমাদের ছেড়ে যাবেন না।’’ কেউ চেম্বারে ঢুকে তুললেন সেলফি। এক দল আবার প্রকাশ করলেন ক্ষোভ। তাঁদের দাবি, ‘সূর্য সেনের অপমান’ করা হচ্ছে।
সোমবার বেলা ১টা নাগাদ সল্টলেকের বাড়ি থেকে বার হন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেখান থেকে হাই কোর্টে পৌঁছনোর কথা ছিল। শেষ দিনে বিচারপতি পৌঁছনোর আগেই হাই কোর্টে পৌঁছে যান তাঁর অগণিত ‘ভক্ত’। প্রায় সকলেই ‘আবেগতাড়িত’। বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানাতে আদালতে ছুটে যান বীরভূমের সীমা দাস। বীরভূমের ইলামবাজারের বাসিন্দা ৫৫ বছরের সীমা এর আগে নানা সমস্যা নিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে এসেছিলেন। বিচারপতি তাঁর সমস্যা সমাধানের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তাই বিচারপতি তাঁর কাছে ‘ভগবান’। সীমার সঙ্গে ছিলেন তাঁর কন্যা মিতালিও। সীমা বলেন, ‘‘আজ শেষ দিনে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। তিনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন।’’
শুধু সীমা বা মিতালিই নন, সোমবার হাই কোর্টে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসের সামনে ক্রমেই জমতে থাকে ভিড়। কারও গলায় শোনা যায় হাহুতাশ, কারও ইচ্ছা, বিচারপতিকে শেষ বারের জন্য ধন্যবাদ জানাবেন। নৈহাটির এক মহিলা কাঁদো কাঁদো সুরে বলে উঠলেন, ‘‘বিচারপতি চলে যাচ্ছেন, এ বার আমাদের কী হবে?’’
দুপুর আড়াইটের পরে তিনি এজলাসে বসেন। সোমবার তাঁর এজলাসে যে যে মামলা ওঠার কথা ছিল, সেগুলি গিয়েছে বিচারপতি মান্থার এজলাসে। দুপুর ২টো ৪৭ মিনিটে শেষ বারের মতো এজলাস ছাড়েন তিনি। শেষ মামলার নির্দেশে জড়িয়ে রয়েছে সেই পূর্ব মেদিনীপুর, যা নিয়ে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে জল্পনা। সেই জেলার বিচারককে বরখাস্তের অনুরোধ করেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রধান বিচারপতিকে রিপোর্ট দেখে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করতে অনুরোধ করেছেন তিনি। ঘটনাচক্রে, ওই জেলা থেকেই তিনি ভোটে লড়তে পারেন বলে জল্পনা চলছে।
সোমবার ওই মামলায় বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘‘হাই কোর্টের ভিজিল্যান্স বিভাগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ তুলেছে জেলার বিচারকের বিরুদ্ধে। আমি প্রধান বিচারপতিকে ওই রিপোর্টটি দেখে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করতে অনুরোধ করব।’’ তিনি এ-ও জানান, ওই রিপোর্ট সত্যি প্রমাণিত হলে জেলা বিচারককে বরখাস্ত করা উচিত। শুনানি শেষ হয়েছে, রায় ঘোষণা স্থগিত রয়েছে, এমন মামলাও ছেড়ে দিয়েছেন বিচারপতি।
রবিবার সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, আগামী মঙ্গলবার তিনি ইস্তফা দিতে চলেছেন। এর পর ‘বৃহত্তর ক্ষেত্রে’ যেতে চলেছেন। সেটা যে রাজনৈতিক ক্ষেত্র, তা-ও জানিয়েছেন বিচারপতি। তবে কোন দলে যাচ্ছেন, সে কথা রবিবার জানাননি বিচারপতি। তার পরেই তৈরি হয়েছে জল্পনা। তিনি জানিয়েছেন, তৃণমূলে কোনও ভাবেই নয়, অন্য কোনও দলে। এবং যে দলে যাবেন, সে দল তাঁকে প্রার্থী করলে আসন্ন লোকসভা ভোটে লড়ার কথাও তিনি ভেবে দেখবেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন তিনি। লোকসভা ভোটে প্রার্থী হচ্ছেন পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক কেন্দ্র থেকে। যে কেন্দ্রে এখন খাতায়কলমে ‘তৃণমূল’ সাংসদ শিশির অধিকারীর পুত্র তথা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী সাংসদ। ঘটনাচক্রে, তাঁর শেষ রায়েও জড়িয়ে রইল সেই পূর্ব মেদিনীপুর।
সোমবার শেষ বারের মতো এজলাসে বসার পর এক আইনজীবী তাঁকে বলেন, ‘‘আমাদের ছেড়ে যাবেন না।’’ বিচারপতি বলেন, ‘‘আমার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন অন্য কাজ রয়েছে।’’ এর পরেই তিনি নির্দেশ দেন, ‘‘সব মামলা ছেড়ে দিচ্ছি, এটা লিখে দিন। পার্ট হার্ড ম্যাটারও ছেড়ে দিচ্ছি। একটা মামলা শুধু আমি দেখতে চাই।’’ অন্য এক আইনজীবী বলেন, ‘‘আমাদের জন্য কালো দিন।’’ বিচারপতি বলেন, ‘‘এখানে আমার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন অন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
এজলাসে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে চান এক মহিলা। বিচারপতি বলেন, ‘‘পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম আমি নিই না।’’ ওই মহিলা বলেন, ‘‘তা হলে আশীর্বাদ করুন যাতে সঠিক বিচার পাই।’’ এক মহিলা জামশেদপুর থেকে এসেছিলেন হাই কোর্টে। বিচারপতির ইস্তফার খবর জেনে তিনি কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘‘কেন চলে যাচ্ছেন স্যর। এটা তো আমাদের কাছে মন্দির। চলে যাবেন না স্যর।’’ বিচারপতি বলেন, ‘‘আমাকে চলে যেতে হবে।’’
দুপুর ২টো ৪৭ মিনিটে শেষ বারের মতো এজলাস ছেড়ে বেরিয়ে যান বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এজলাস থেকে বেরিয়ে উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে হাত নাড়েন। হাতজোড় করে নমস্কার করেন। রাজনৈতিক নেতাদের ঢঙেই। তার পর চলে যান নিজের চেম্বারে। সেখানে তার পর রীতিমতো ভিড়ের ঢল নামে। কখনও আইনজীবী, কখনও আদালতের কর্মীরা তাঁর ঘরে আসেন। কথা বলেন। তাঁদের আবদারে নিজস্বী তোলেন বিচারপতি।
যখন একের পর এক আইনজীবী এসে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন, তখনই ক্ষোভ প্রকাশ করে বামপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন। রবিবার বিচারপতি ঘোষণা করেছিলেন, মঙ্গলবার মাস্টারদা সূর্য সেনের মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করবেন তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ। সেই প্রসঙ্গে তিনি বর্তমান সরকারকে একহাত নেন। এ বার বিচারপতির ঘোষণার স্থান নির্বাচন নিয়ে সরব হয়েছে বামপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন। তাদের তরফে জানানো হয়, মাস্টারদা সূর্য সেনের মূর্তির পাদদেশ রাজনৈতিক দলবদল করে ঘোষণা করার, সাংবাদিক সম্মেলন করার মঞ্চ নয়। জল্পনা, বিচারপতি যোগ দিতে পারেন বিজেপিতে। সেই জল্পনা প্রসঙ্গে সংগঠন আরও বলে, ‘‘আমাদের দেশের রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধীকে যে নাথুরাম গডসে খুন করেছিলেন, যদি কেউ মনে করেন সেই নাথুরাম গডসের উত্তরাধিকারীদের দলে যোগদান করার জন্য মাস্টারদা সূর্য সেনের মূর্তির পাদদেশকে বেছে নেবেন, তা হলে বারবার প্রতিবাদ হবে। এ ভাবেই হবে।’’
গোটা সন্ধ্যা নিজের চেম্বারেই কাটান বিচারপতি। সেখানে উপস্থিত হয় সংবাদমাধ্যমও। তার সঙ্গে অগণিত মানুষ। অনেকেই ভিড় ঠেলে চেম্বারে আর ঢুকতে পারেননি। তাঁরা মন খারাপ নিয়েই ফিরে যান। এর মধ্যেই হাই কোর্টের তরফে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে যে মামলা ছিল, সেগুলি গেল বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের বেঞ্চে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে ছিল শ্রম এবং শিল্প সংস্থা সংক্রান্ত কিছু মামলা। এ বার থেকে সেই মামলাগুলি শুনবেন বিচারপতি মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবার হাই কোর্টে বিচারপতিদের শুনানির তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম।
এই বিজ্ঞপ্তি যখন জারি হয়, তখন নিজের ঘরে ব্যক্তিগত কাজ সারতে ব্যস্ত ছিলেন বিচারপতি। অবশেষে, রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে হাই কোর্ট থেকে বেরিয়ে উঠে পড়েন নিজের গাড়িতে। এক বার কি পিছনে ফিরে তাকান নিজের ছ’বছরের পুরনো কর্মস্থলের দিকে! ২০১৮ সালে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন তিনি। তার আগে এই হাই কোর্টেই আইনজীবী ছিলেন তিনি। সেই কর্মস্থলকে শেষ বিদায় জানাতে কি তিনিও এক বারও আবেগতাড়িত হলেন! নাকি চোখ এখন শুধুই মাস্টারদা সূর্য সেনের মূর্তি... আর তার পর লোকসভা নির্বাচন! রাত ১১টা ২৭ মিনিটে নিজের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy