আরজি কর পর্বে অডিয়োকাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছিলেন সিপিএমের যুবনেতা কলতান দাশগুপ্ত। পাঁচ মাস আগের সেই ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ দাবি করেছিলেন, তদন্তের স্বার্থে পুলিশ কলতানের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করবে। সিপিএম যেন পিছিয়ে না যায়। বিকালে সেই কুণালই অডিয়ো ক্লিপ ফের শুনিয়ে সরাসরি নিশানা করলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে। পাল্টা জবাব দিলেন সেলিমও।
আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে গত বছর ৯ অগস্ট সকালে। তার পর থেকে কী ভাবে নাগরিক আন্দোলন এগিয়েছিল তা সর্বজনবিদিত। একের পর এক নাগরিক আন্দোলনে ঝান্ডা ছেড়ে মিশে থেকেছিল বামেরা। সেপ্টেম্বরে যখন সল্টলেকের স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অনির্দিষ্টকাল অবস্থান চলছিল, সেই সময়েই একটি অডিয়ো ক্লিপ নিয়ে তোলপাড় হয়। যে অডিয়োর মূল প্রতিপাদ্য ছিল, জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে ‘রক্তাক্ত হামলার ছক’। হালতুর সঞ্জীব দাসের সঙ্গে কলতানের কথোপকথন প্রকাশ্যে এনেছিলেন তৃণমূল নেতা কুণালই। ১৪ সেপ্টেম্বর বিকালে কুণাল তা ফাঁস করেন। সেই অডিয়োয় একাধিক চরিত্রের উল্লেখ ছিল। যেমন, ‘বাপ্পাদা’, ‘সাহেব’ এবং ‘দাদু’।
কুণাল বৃহস্পতিবার বিকালে বলেছেন, ‘‘কে ওই সাহেব? আমরা জানি না। কিন্তু সিপিএমের ভিতর থেকেই খবর আসছে, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে দলের অন্দরে ‘সাহেব’ বলা হয়। ওই সাহেব কি সেলিম? যাঁদের মধ্যে কথোপকথন হয়েছিল (কলতান এবং সঞ্জীব) তাঁদের ভাল করে জেরা করে, কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করে পুলিশ খুঁজে বার করুক সাহেব কে।’’ কুণালের এ-ও বক্তব্য, ‘‘সে দিন হামলা হয়নি। কিন্তু হলে সরকার, প্রশাসন, মুখ্যমন্ত্রীকে কী পরিমাণ কুৎসার মুখে পড়তে হত তা অনুমেয়। তাই তদন্ত জরুরি।’’
কুণালের বক্তব্য প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, ‘‘প্রথমত, যিনি তৃণমূলের মুখপাত্র হয়ে এ সব বলছেন, তিনি তৃণমূলের ভিতরের কথা জানেন না। কিন্তু সিপিএমের ভিতরের কথা জানলেন কী করে? দ্বিতীয়ত, যখন ‘কাকু’র (কালীঘাটের কাকু সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র) কণ্ঠস্বর নিয়ে কথা হওয়ার কথা, তখন কলতানকে নিয়ে এত কলরব কেন? তৃতীয়ত, উনি (কুণাল) মুজতবা আলি পড়েননি। পড়লে জানতেন সেলিম সাহেব নয়। সেলিম কমরেড।’’
উল্লেখ্য, অডিয়ো ক্লিপে ‘বাপ্পাদা’ নামে এক চরিত্রের কথা শোনা গিয়েছিল। আবার সেলিমের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত এক ব্যক্তিরও ডাকনাম বাপ্পা। কয়েক মাস আগে তাঁকে ইলেক্ট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডেকেছিল। সেই সময়ে তাঁর ফোনটিও বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিকালে অডিয়ো প্রকাশ্যে এনেছিলেন কুণাল। সেই রাতেই সঞ্জীবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে দিন কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের অপসারণের দাবিতে সিপিএমের ‘লালবাজার অভিযান’ ছিল। সারা রাত লালবাজারের অদূরে অবস্থান করেছিলেন বাম কর্মীরা। সেখানে কলতানও ছিলেন। পর দিন ভোরে বৌবাজারের অদূরে ফিয়ার্স লেন থেকে কলতান যখন ফিরছিলেন, তখন তাঁকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পরে কলতান হাই কোর্টের নির্দেশে জামিন পেলেও তদম্ত চলছে।
প্রশাসন ও তৃণমূল সূত্রে খবর, গত মঙ্গলবার কলতানকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। সূত্র মারফত এ-ও জানা গিয়েছে, কলতানকে পুলিশ মৌখিক ভাবে জানিয়েছে, তাঁর কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহের জন্য নোটিস পাঠানো হবে। প্রশাসনিক বিষয়ে তৃণমূলের যে অংশ খোঁজখবর রাখে, তাঁদেরই অনেকে বলছেন, কলতানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ সিপিএমের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে, যা পরবর্তী তদন্তে ভূমিকা নিতে পারে। তৃণমূলের অনেকের এ-ও বক্তব্য, জনৈক ‘বাপ্পা’র সঙ্গে সঞ্জীবের যোগ রয়েছে। আবার সিপিএমের একটি সূত্র বলছে, একটা সময়ে হালতুর সঞ্জীব ছিলেন বর্তমানে প্রবীণ এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের ছায়াসঙ্গী। কৌতূহল এ-ও তৈরি হয়েছে যে, অডিয়ো ক্লিপে উচ্চারিত হওয়া ‘দাদু’ কে? আরজি করের ধর্ষণ ও খুনের মামলার বিচারপ্রক্রিয়া যখন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনের ‘আ’-ও যখন নেই, তখন আন্দোলন সপ্তমে থাকার সময়ের কলতানদের অডিয়োকাণ্ড নতুন মোড় নিল। যেখানে মূল আলোচ্য হয়ে উঠল সিপিএমের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ। কাল বাদে পরশু সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন শুরু। তার আগে নতুন ‘বিড়ম্বনা’ আলিমুদ্দিনের।