নাম না করে শুভেন্দুকে (বাঁ দিকে) আক্রমণ কুণালের (ডান দিকে)।
বিকৃত যৌনতা ফাঁস করে দিতে পারে নিরাপত্তারক্ষী! তাই তাঁকে খুন করেন ‘এক নেতা’। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে কোনও নাম না করেই এমন অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূল মুখপাত্র তথা শাসকদলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ। নাম না-করলেও কুণালের ওই ‘যৌনবিকৃতি’র আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কারণ, কুণাল বারংবারই বলেছেন, ‘‘শুভেন্দু অধিকারী সমকামী কি না, তা আমি জানি না। আমি ওই বিষয়ে কিছু বলছিও না।’’
বুধবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুকে ‘পুরুষ পছন্দ-করা নেতা’ বলে আক্রমণ করেছিলেন। তার পরেই বৃহস্পতিবার কুণালের এই আক্রমণ। তৃণমূলের মুখপাত্র বলেন, ‘‘কোনও এক জন নেতা, যাঁর নাম বলব না, শুভেন্দুকেও বলছি না, সেই নেতা যৌনবিকৃত, হোমোসেক্সুয়াল, সমকামী। তাঁর এক দেহরক্ষীকে বিকৃত যৌনতা দেখাতে গিয়েছিলেন। সেই দেহরক্ষী বাইরে বলে দেবেন সেই ভয়ে তাঁকে খুন করা হয়েছে। তার পর তাকে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়েছে। সেই নেতা কে?’’ এর পরেই কুণাল বলেন, ‘‘পুলিশের তদন্ত মাঝপথে আটকে রয়েছে। আমরা পুলিশকে বলছি, কোথায় কোন কোর্টে আটকে রয়েছে, জানার দরকার নেই। রক্ষীর বাড়ি যেন ন্যায্যবিচার পায়। পুলিশ দেখুক, সেই নেতা কে!’’
কুণাল নাম করেননি। কিন্তু ওই আক্রমণ শুভেন্দুকে লক্ষ্য করে বলেই মনে করছে বিজেপি। যার জবাব দিতে গিয়ে কুণালকে ‘বাচাল ঘোষ’ বলে আক্রমণ করেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সেই সঙ্গে এই ধরনের ভাষাকে ‘নিম্নরুচি’-র বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে কুণালের মন্তব্যের কোনও জবাবি মন্তব্য করতে রাজি হননি শুভেন্দু। বিধানসভায় সাংবাদিক বৈঠকে এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘কোনও জেল-খাটা লোকের কথার উত্তর আমি দেব না। তিন বছর জেল-খাটা নর্দমার কীট! তার কথার জবাব দিতে আমার রুচিতে বাধে।’’ তবে জবাব দেবেন না জানালেও শুভেন্দু কুণালকে ‘ভাইপোর বেতনভুক কর্মী’ বলে পাল্টা দিয়েছেন। বিরোধী দলনেতার কথায়, ‘‘যে ভাইপোর বেতনভুক কর্মী, তার কথার উত্তর আমি দেব না।’’
বস্তুত, বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রতিক কালে এমন ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ দেখা যায়নি। বুধবার ওই বিতর্ক শুরু হয়েছে। যার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল মঙ্গলবার বিজেপির নবান্ন অভিযান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। মঙ্গলবার বিজেপির নবান্ন অভিযান আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরুর আগেই পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। রেসকোর্সের সামনে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়ান শুভেন্দু। সে সময় এক মহিলা পুলিশকর্মীর উদ্দেশে শুভেন্দুকে বলতে শোনা যায়, ‘‘ডোন্ট টাচ মাই বডি!’’ এর পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার আকাশ মাঘারিয়াকে শুভেন্দু বলেন, ‘‘এখানে সব লেডি পুলিশ আমার গায়েও হাত দিচ্ছে। এটা তাঁরা করতে পারেন না। আপনাদের বিরুদ্ধে আমি আদালতে যাব।’’ মাঘারিয়া বলেন, ‘‘স্যর, আমাদের বাহিনীতে নারী-পুরুষ ভাগ হয় না।’’ এর পর শুভেন্দু দাবি করেন, মহিলা পুলিশ অফিসাররা তাঁকে ‘নিগ্রহ’ করেছেন। পুলিশের উদ্যোগে তাঁকে ‘ফাঁদে ফেলা’র চেষ্টা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বিজেপির অভিযানের সময় প্রহৃত কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দেবজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বুধবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন অভিষেক। দেবজিতের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে অভিষেক হাতপাতাল চত্বরেই সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘গত কালের (মঙ্গলবারের) ঘটনা দেখে আমার বিলম্বিত বোধোদয় হয়েছে। এক জন মহিলা পুলিশকর্মী ওঁকে (শুভেন্দু) অনুরোধ করে ভ্যানে উঠতে বলেছিলেন। উনি শুনে বলেন, ‘আমি মেলস! আপনি মহিলা। ডোন্ট টাচ মি!’ এখন বুঝতে পারছি, সুদীপ্ত সেন যদি পুরুষ না হয়ে মহিলা হতেন, অর্থাৎ সুদীপ্তা হতেন, তা হলে ওঁর কাছ থেকে তিনি টাকা নিতেন না। বা নারদ স্টিং কাণ্ডে ম্যাথু স্যামুয়েল না গিয়ে যদি অ্যাঞ্জেলিনা স্যামুয়েল যেতেন তা হলেও উনি টাকা নিতেন না।’’
কুণাল সেই প্রসঙ্গ টেনে বৃহস্পতিবার আক্রমণ করলে সুকান্ত বলেন, ‘‘এগুলো নিম্নরুচির কথাবার্তা। বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূল যে ভাবে অশিক্ষিতদের প্রবেশ ঘটিয়েছে, তার ফলেই বাংলার রাজনীতির এই দুর্দশা। এই বিলো দ্য বেল্ট অ্যাটাক অত্যন্ত নিন্দাজনক। সম্মানীয় বিরোধী দলনেতাকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথাগুলো বলেছেন এবং এখন কুণাল ঘোষ বলছেন, তা তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি এবং রুচি প্রমাণ করে।’’
তবে সেখানেই না থেমে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে হাঁটেন সুকান্তও। বিজেপি রাজ্য দফতরে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘অভিযোগ তো অনেক কিছুই আছে! শুভেন্দু’দা তো দীপকবাবুর (প্রাক্তন আমলা এবং তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক দীপক ঘোষ) বই দেখিয়েছেন। আমরা সেগুলো নিয়ে বলি কোথাও? আমরা কি আলোচনা করি কার সঙ্গে কার মুখের মিল পাওয়া যায়! আমরা তো আলোচনা করি না!’’
যে ভাবে রাজনীতিতে পাল্লা দিয়ে ‘ব্যক্তি আক্রমণ’-এর চাপানউতোর বাড়ছে, তার সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযানে আহত বিজেপি কাউন্সিলার মীনাদেবী পুরোহিতকে মেয়র ফিরহাদ হাকিমের হাসপাতালে দেখতে যাওয়া বা সুকান্তের ফোনে আহত পুলিশ অফিসারের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া। মীনাদেবীকে দেখতে গিয়ে ফিরহাদ বলেছিলেন, ‘‘রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়। উনি দীর্ঘ দিনের কাউন্সিলার। আমরা কলকাতা পুরসভায় বহু দিনের সহকর্মী। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে দেখতে এসেছি। মুখ্যমন্ত্রী আমায় পাঠিয়েছেন ওঁর খোঁজ নিতে।’’ আর সুকান্ত বলেছিলেন, ‘‘উনি পুলিশ অফিসার বলে কি মানুষ নন? তিনি আহত হয়েছেন। এক জন মানুষ হিসেবেই তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছি।’’
বুধবারের সেই ‘সৌজন্য’ দিন ফুরোনোর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। উল্টে শুরু হয়েছে ‘ব্যক্তি আক্রমণ’। এখন দেখার, এই ধারাই অব্যাহত থাকে, না কি রাশ টানে দু’পক্ষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy