Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ডুবলেন সহযাত্রী, মরিয়া চেষ্টা করেও ব্যর্থ সাঁতারু

পকেটের কয়েকশো টাকা, ঘড়ি বা মোবাইল ফোনটা কোথায় পড়ে রইল, তার দিকে দৃকপাতও করেননি মধ্য চল্লিশের সুরজিৎ ঘোষ। তবে জামাজুতো ছাড়তে সময় নিয়েছিলেন কয়েক সেকেন্ড। তা ছাড়া উপায়ও ছিল না। প্রাক্তন জাতীয় সাঁতারু জানতেন, মাঝগঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে উজান ঠেলতে হলে শরীরে পোশাকের ভার থাকা চলবে না। হাতের কাছে লঞ্চের সবেধন নীলমণি ফাটা টায়ারটা ঠেলতে ঠেলতে প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিলেন হাত-পা ছুড়ে বাঁচার চেষ্টায় মরিয়া লোকটির কাছে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

সুরজিৎ ঘোষ। মঙ্গলবার, গঙ্গার ফেরিঘাটে।  নিজস্ব চিত্র

সুরজিৎ ঘোষ। মঙ্গলবার, গঙ্গার ফেরিঘাটে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:০০
Share: Save:

পকেটের কয়েকশো টাকা, ঘড়ি বা মোবাইল ফোনটা কোথায় পড়ে রইল, তার দিকে দৃকপাতও করেননি মধ্য চল্লিশের সুরজিৎ ঘোষ। তবে জামাজুতো ছাড়তে সময় নিয়েছিলেন কয়েক সেকেন্ড। তা ছাড়া উপায়ও ছিল না।

প্রাক্তন জাতীয় সাঁতারু জানতেন, মাঝগঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে উজান ঠেলতে হলে শরীরে পোশাকের ভার থাকা চলবে না। হাতের কাছে লঞ্চের সবেধন নীলমণি ফাটা টায়ারটা ঠেলতে ঠেলতে প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিলেন হাত-পা ছুড়ে বাঁচার চেষ্টায় মরিয়া লোকটির কাছে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। “ওঁর ব্যাগটা ধরে ফেলেছিলাম আমি। আর দু’চার সেকেন্ড সময় পেলেই হয়তো বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু তিনি যে আর ভাসতেই পারলেন না।”

মঙ্গলবার সকালে হাওড়া থেকে শিপিং কর্পোরেশন যাওয়ার পথে মাঝগঙ্গায় লঞ্চ থেকে পড়ে যান এক যাত্রী। তাঁকে বাঁচাতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন পূর্ব রেলের করণিক সুরজিৎবাবু। ব্যাগটার নাগাল পেলেও মানুষটিকে ছুঁতে পারেননি। ব্যাগ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পুলিশ পরে নিশ্চিত হয়, ওই যাত্রীর নাম বিদ্যুৎ দুয়ারি (৪৬)। একটি বেসরকারি সংস্থার ওই কর্মীর বাড়ি উলুবেড়িয়ার চেঙ্গাইলে। এখনও তাঁর খোঁজ নেই।

সুরজিৎবাবু বালির কৈলাস ব্যানার্জি রোডের বাসিন্দা। বিকেলে বাড়িতে বসে তীব্র আফশোসের সুরে বারবার একটা কথাই বলছিলেন। “দেশের হয়ে সাঁতারে জিতে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়ানোর অনুভূতি আমার চেনা। কিন্তু এত কাছে এসেও একটা আস্ত জীবন হাত থেকে ফস্কে যাওয়ার কষ্ট ভুলতে পারব না। মনে হচ্ছে, রাতে শুয়ে দু’চোখের পাতা এক করতে পারব না।” দু’দশক আগে ইতালিতে বিশ্ব সুইমিং মিটের দু’টি ব্যক্তিগত ইভেন্টে ফাইনাল অবধি গিয়েছিলেন। এশীয় স্তরে দেশের হয়ে ১৯টি, বাংলার হয়ে ১০০টির বেশি পদক আছে আপাত সাধারণ এই মধ্যবয়সীর। হাওড়া থেকে লঞ্চে নিত্য অফিসযাত্রী সুরজিতের মরীয়া চেষ্টাটুকুই মাঝগঙ্গায় দুর্ঘটনার সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলল।

স্ত্রী শিপ্রা বা স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ের কাছে অবশ্য এ সব কাণ্ড নতুন কিছু নয়। বালি সুইমিং সেন্টারের পোড় খাওয়া ট্রেনার সব সময়েই জল দেখলে সজাগ। অন্তত ছ’-সাত বার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ছোঁ মেরে আনাড়ি সাঁতারুদের বাঁচিয়েছেন তিনি। এক বার রেললাইনে ট্রেনের সামনে স্নায়ুর অসুখে থমকে যাওয়া এক প্রৌঢ়কেও ঝাঁপ দিয়ে বাঁচান তিনি। গরবিনী শিপ্রা লাজুক হেসে বলছিলেন, “ওরও (সুরজিৎ) তো বয়স হচ্ছে। দম আগের মতো নেই। কিন্তু কারও বিপদ দেখলে নিজেকে সামলাতে পারে না যে।”

সুরজিতের কথায়, “রোজ লঞ্চে যাতায়াতের সময়ে একদৃষ্টে জলে তাকিয়ে কী ঘটছে দেখাটাই আমার স্বভাব।” এ দিন লঞ্চ বাঁক নেওয়ার সময়ে এক যাত্রীর পড়ে যাওয়ার শোরগোল তাই তখনই টের পান। গঙ্গায় তখন ভাটা চলছে। লঞ্চটাও অন্য দিকে দ্রুত সরে আসছিল। স্রোতের উল্টো দিকে ঝাঁপানোর সিদ্ধান্ত নিতে তবু দু’বার ভাবেননি সুরজিৎ।

একটি জীবন বাঁচাতে না-পারার কষ্ট যেমন আছে, তেমনই ভূতল পরিবহণ নিগমের লঞ্চে নিরাপত্তার অভাবে ক্ষুব্ধ সুরজিৎ। বলছিলেন, “বিপদে পড়লে কোনও যাত্রীকে জল থেকে উদ্ধারের মতো কেউ ছিল না লঞ্চে।” এই দুর্ঘটনা কী ভাবে ঘটল, তার খোঁজ করবেন বলে জানান নিগম-কর্তারা। একটা মাত্র ফাটা টায়ার ঠেলে এ দিন সাঁতরানোর চেষ্টা করেন সুরজিৎবাবু। সাঁতারে জাতীয়-আন্তর্জাতিক আসরে অভিজ্ঞতা থাকলেও অখ্যাতই থেকে গিয়েছেন তিনি। তবু বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে পান।

তিনি বলছিলেন, “এর আগে আর এক বার গঙ্গাতেই ডুবন্ত এক যুবককে ধরে ফেললেও বাঁচাতে পারিনি। কোথাও গুঁতো খেয়ে লোকটার মাথার ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।” এ যাত্রাও একটুর জন্য ডুবন্ত মানুষটিকে ধরতে ব্যর্থ সুরজিৎ। “জুতো খোলার সময়ে ফিতের গিঁট পড়ে একটু সময় লেগে যায়। চোখের সামনে দেখলাম, তিনি তলিয়ে গেলেন। এই আফশোস কিছুতেই কাটবে না।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy