Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
Calcutta Pavlov Hospital

বাড়ি ফিরলেন আইনি জটে ‘পাগল’ তকমায় বন্দি যুবক

পাভলভ সূত্রের খবর, শিয়ালদহের কাছে রেললাইনে নামমাত্র পোশাকে বেহুঁশ অবস্থায় ওই যুবককে উদ্ধার করে রেলরক্ষী বাহিনী।

চন্দ্রশেখর ভুদয়

চন্দ্রশেখর ভুদয়

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:৪৮
Share: Save:

‘‘কে ফিরিয়ে দেবে আমার জীবনের একটা বছর? দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতা নিয়ে কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছি।’’ — সম্প্রতি হাওড়া স্টেশনে হায়দরাবাদগামী ট্রেনে বসে বলছিলেন চন্দ্রশেখর ভুদয়। কোনও এক দুর্ঘটনায় পড়ে পাকেচক্রে এ শহরে এসে দশ মাস ‘বন্দিদশা’য় কাটানোর পরে ফেরার সময়ে কথাটা বলছিলেন তিনি। নিজের শহরে ফিরে খানিক থিতু হয়ে অবশ্য কলকাতার আর একটা দিকের কথাও তাঁর মনে পড়ছে। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পাভলভ মানসিক হাসপাতালে দশ মাস কাটানো ৪২ বছরের যুবক ফোনে বললেন, ‘‘পুলিশ, প্রশাসন আমার কথা শোনেনি। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতা মনে রাখব। ওরা পাশে না দাঁড়ালে হাসপাতালেই পড়ে থাকতাম।’’

ঘটনার সূত্রপাত গত ফেব্রুয়ারিতে। পাভলভ সূত্রের খবর, শিয়ালদহের কাছে রেললাইনে নামমাত্র পোশাকে বেহুঁশ অবস্থায় ওই যুবককে উদ্ধার করে রেলরক্ষী বাহিনী। আদালতের নির্দেশে তাঁর ঠাঁই হয় পাভলভ মানসিক হাসপাতালে। কয়েক দিনেই বোঝা যায়, চন্দ্রশেখর পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আদালতের নির্দেশ বা ওই যুবকের বাড়ির লোকের উপস্থিতি ছাড়া তাঁকে ছাড়া যেত না। লকডাউনের কারণেও মুক্তির ব্যবস্থাপনা থমকে যায়। হাসপাতালের এক কর্তার কথায়, ‘‘পুরনো আইন মোতাবেক এই ভাবেই যে কোনও লোক একটু সমস্যায় পড়লেই তাঁকে মানসিক হাসপাতালে চালান করাটা দস্তুর। ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী, এই বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য হাসপাতালে একটি রিভিউ কমিটি তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এত দিনেও তা কার্যকর করা হয়নি। উল্টে, পুরনো আইনে বিভিন্ন আদালতের নির্দেশে লোকজনকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। পরিবারের খোঁজ না-মিললে তাঁরা পড়েও থাকছেন সেখানে।’’

হায়দরাবাদের বাসিন্দা চন্দ্রশেখরের কথায়, ‘‘আমার স্ত্রী মণিপুরের মেয়ে। পেশায় নার্স। বৌ, মেয়ের সঙ্গে দেখা করে ডিমাপুর থেকে ট্রেনে অসংরক্ষিত আসনে দিল্লি যাচ্ছিলাম। ট্রেনেই ভাব হওয়া কয়েক জন হিন্দিভাষী যুবকের সঙ্গে রুটি-তরকারি ও নরম পানীয় ভাগ করে খাওয়ার কথা মনে আছে। নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশনের পরে কী হয়েছিল, আর মনে নেই।’’ চন্দ্রশেখর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছেন, কলকাতায় নারকেলডাঙা থানার জিম্মায় পৌঁছে তিনি বার বার পুলিশকে নিজের ইমেল আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়ে বলেন, ওখানে তাঁর পরিচিতির হদিস মিলবে। তবু শেষমেশ হাসপাতালেই পাঠানো হয় তাঁকে।

কয়েক দিন বাদে পাভলভে মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নজরে আসেন তিনি। চন্দ্রশেখরের মা, বাবা বৃদ্ধ। নিজেরা কলকাতায় আসার অবস্থায় ছিলেন না। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার থেকে সব জানতে পেরে কলকাতার এক আত্মীয়কে পাভলভে যেতে বলেন তাঁরা। এর পরেই মুক্তির জট খুলতে শুরু করে। কিন্তু তত দিনে বেশ কয়েক মাস কেটে গিয়েছে।

পাভলভে সক্রিয় ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক শুক্লা দাস বড়ুয়া বললেন, ‘‘নতুন আইন বলবৎ না-হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। যাঁকে তাঁকে জঞ্জাল জ্ঞান করে মানসিক হাসপাতালে ডাঁই করাটাই এখন প্রশাসনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সুস্থ লোকেও হাসপাতালে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।’’ সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের কথায়, ‘‘এ হল, সুস্থ মানুষকে প্রান্তিক করে রাখার ষড়যন্ত্র। কেউ অসুস্থ হলে মাস দুয়েকে সেরেও ওঠেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ফিরতে চাইলেও আইনের নামে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয়।’’

দশ মাস ধরে চন্দ্রশেখর তবু দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছেন। পুজোয় অন্য আবাসিকদের সঙ্গে পাভলভের স্থাপনা-শিল্প গড়ে তুলতেও হাত লাগিয়েছেন সৃষ্টিশীল মননের ওই যুবক। হায়দরাবাদে ফিরেই নিজের ব্যবসার কাজ শুরু করছেন। ২০২০ সালটা অনেকেরই খারাপ কেটেছে। তবু বছর শেষের আগে ফিরতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলছেন তিনি।

অন্য বিষয়গুলি:

Calcutta Pavlov Hospital Youth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE