Writers’ Building was originally built as the principal administrative office for junior clerks of the British East India Company dgtl
Writers' Building
করণিকদের জন্য বাড়ি তৈরি করেন বিদেশি ছুতোর! পরিত্যক্ত গির্জার জমিতে তৈরি হয় মহাকরণ
উপনিবেশ কলকাতায় এসে টমাস লিয়ন হয়ে গেলেন স্থপতি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকেই দিল এক বিশাল বাড়ি তৈরির কাজ।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২১ ০৯:১১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
ইংল্যান্ডে ছিলেন ছুতোর। উপনিবেশ কলকাতায় এসে টমাস লিয়ন হয়ে গেলেন স্থপতি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকেই দিল এক বিশাল বাড়ি তৈরির কাজ। সে বাড়িতে বসে কাজ করবেন করণিকরা। সাম্রাজ্য যত বাড়ছিল, ততই দরকার হয়ে পড়ছিল কাজ করার লোকের। প্রথমে ব্রিটিশ-সহ ইউরোপীয়রাই ছিলেন সেই শ্রেণিতে। পরে তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিল শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায়।
০২২০
কালের স্রোতে গুরুত্বভার হারিয়ে ‘করণিক’ হয়ে গেল ‘কেরানি’। লিয়ন সাহেবের পরিকল্পনায় তৈরি সেই বাড়িতে বসে তাঁরা কাজ করতেন। তাই লাল ইটের সেই ভবনের নাম হল ‘মহাকরণ’।
০৩২০
করণিকদের কাজ ছিল মূলত লেখালেখির। কলম পেষার কাজ থেকেই কোম্পানির নিচুতলার এই কর্মীদের পরিচয় ছিল ‘রাইটার’। তাঁরা যে বাড়িতে বসে কাজ করেন, সেটাই ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। এই ভবন নির্মাণের জন্য যে জমি নির্ধারিত হয়েছিল, সেখানে আগে ছিল সেন্ট অ্যান চার্চ। ষোড়শ শতকের প্রথমে তৈরি এই গির্জা ছিল কলকাতায় ব্রিটিশদের তৈরি প্রথম উপাসনাস্থল। কিন্তু দু’দশকের বেশি স্থায়ী হয়নি তাঁর অস্তিত্ব।
০৪২০
রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে গির্জাটি। শেষে কার্যত পরিত্যক্ত গির্জা এবং তার চারপাশের জমিই নির্ধারিত হল রাইটার্স বিল্ডিং তৈরির জন্য। পুরনো ফোর্ট উইলিয়মের কাছে ১৭৭৭ থেকে ১৭৮০, এই ৩ বছর ধরে তৈরি হল করণিকদের ভবন। কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম হেস্টিংস। নতুন ভবন এবং তার চারপাশের এলাকাকে সে সময় এর স্থপতির নামে বলা হত ‘লিয়ন্স রেঞ্জ’।
০৫২০
বরাদ্দ করা জমির ৩৭,৮৫০ বর্গফুট জুড়ে তৈরি হয়েছিল ভবনের মূল অংশ। কলকাতায় এটাই নাকি প্রথম তিন তলা বাড়ি। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রথমে ১৯টি থাকার ভবন ছিল। তবে এর চেহারা দেখে হতাশ হয়েছিল সেকালের ব্রিটিশ সমাজ। তাঁদের কাছে মনে হয়েছিল ভবনটিকে দেখতে কোনও মলিন হাসপাতালের মতো।
০৬২০
ভবনটির গঠনশৈলি মুগ্ধ করতে পারেনি কলকাতায় থাকা সেকালের ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় সমাজকে। তাঁদের মনে হয়েছিল, কাজের প্রয়োজনে তৈরি এই ভবন দাঁড়িয়ে আছে শিল্পসুষমা থেকে দূরে। তবে উপনিবেশ শাসনের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই এই ভবন ব্রিটিশদের কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
০৭২০
নতুন ভবনে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য সচেষ্ট ছিল ব্রিটিশরা। ইংল্যান্ড থেকে কাজ করতে আসা তরুণরা বাধা পাচ্ছিলেন ভাষা সমস্যার জন্য। সংস্কৃত, বাংলা, উর্দু, আরবি, ফার্সি-সহ একাধিক প্রাচ্য ভাষা শেখানোর প্রয়োজন হল তাঁদের। সেই প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। পরে কিছু জটিলতার জন্য সেই কলেজ উঠে আসে রাইটার্স ভবনে।
০৮২০
কলেজের প্রয়োজনে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হল। ৩২ জন পড়ুয়ার জন্য ছাত্রাবাস, পরীক্ষার হল, লেকচার হল, চারটি লাইব্রেরি-সহ বেশ কিছু নতুন সংযোজন হল দু’দশক ধরে। পরে অবশ্য কলেজটি এখান থেকে আবার স্থানান্তরিত হয়ে যায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে তৈরির মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাইটার্স বিল্ডিংয়ের জন্য দক্ষ কর্মী প্রস্তুত করা।
০৯২০
গ্রেকো রোমান স্থাপত্যের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের নির্মাণশৈলিতে মিশে গিয়েছে ফরাসি নবজাগরণের প্রভাবও। ভবনের মাথায় রয়েছে প্রাচীন রোমান সভ্যতার জ্ঞান, যুদ্ধ ও ন্যায়ের দেবী মিনার্ভার মূর্তি। এ ছাড়াও এই ভবনে আছে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার দেবদেবী জিউস, হার্মিস, আছেনা এবং দিমিতার-এর মূর্তি। তাঁরা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যথাক্রমে বিচার, বাণিজ্য, বিজ্ঞান এবং কৃষির উন্মেষের প্রতীক হয়ে।
১০২০
২৪০ বছরের প্রাচীন এই ভবনে যুগে যুগে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রশাসনিক প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ভবন। কিন্তু আড়ালে চলে গেলেও স্তিমিত হয়নি ব্রিটিশ-সহ অন্য ইউরোপীয় প্রভাব। কলেবরের সঙ্গে বদলেছে ভবনের নামও। টমাস লিয়ন্সের নামে একসময়ে রাইটার্স বিল্ডিং-সহ এই এলাকাকে লিয়ন্স রেঞ্জ বলা হত। কিন্তু সে নাম সূত্রপাতের পরে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
১১২০
বরং, লালদীঘিকে মনে রেখে ঔপনিবেশিকদের কাছে এই চত্বর হয়ে গিয়েছিল ‘ট্যাঙ্কস স্কোয়্যার’। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই এলাকার সঙ্গে জড়িয়ে গেল তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নাম। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬, ৮ বছর তিনি ছিলেন ভারত শাসনের দায়িত্বে। দায়িত্বভার শেষ হওয়ার পরে ফিরে যান জন্মভূমিতে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন স্কটল্যান্ডের মিডলোথিয়ানের ডালহৌসি প্রাসাদে। তাঁর মৃত্যুর ১৬১ বছর পরেও বাঙালি বাসে উঠে ‘একটা ডালহৌসি’-র টিকিট কাটতে অভ্যস্ত।
১২২০
এর রক্তক্ষয়ী পর্বের মধ্যে দিয়ে আমাদের অপিসপাড়া তাঁর নাম পরিচয় পাল্টে হয়ে গিয়েছে ‘বিবাদী বাগ’ হয়ে গিয়েছে, সে কথা আমাদের মনে থাকে না। বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া শহরবাসী বিস্মৃত হলেও রাইটার্স বিল্ডিংয়ের গথিক বারান্দা কিন্তু মনে রেখেছে ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বরের কথা।
১৩২০
সে দিনই পাশ্চাত্য পোশাকে সেজেগুজে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকেছিলেন পূর্ববঙ্গের তিন তরুণ। বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত। তাঁদের লক্ষ্য ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এন এস সিম্পসন। কারাবিভাগের ইনস্পেক্টর জেনারেল পদাধিকারী সিম্পসন কুখ্যাত ছিলেন জেলের ভিতরে বন্দিদের উপর অত্যাচারের জন্য। রাজবন্দিদের উপর তাঁর অকথ্য অত্যাচারের জন্য অনেক দিন ধরেই বিপ্লবীদের মনে পুঞ্জীভূত ছিল ক্ষোভ।
১৪২০
বাঘের ডেরায় ঢুকে শিকার করতে চেয়েছিলেন তিন সশস্ত্র বিপ্লবী। নিজেদের লক্ষ্যে তাঁরা সফল হয়েছিলেন। তাঁদের বুলেটে প্রাণ গিয়েছিল অত্যাচারী সিম্পসনের। বিগত রাজধানীতে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ভবনে ইনস্পেক্টর জেনারেলকে হত্যা করে তাঁরা ত্রস্ত করতে চেয়েছিলেন শাসকদের। তাঁদের সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছিল। সিম্পসন-হত্যায় কেঁপে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসন। দেশকে স্বাধীন দেখার ইচ্ছের পাশাপাশি তাঁদের আরও একটি ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল।
১৫২০
সিম্পসন-হত্যার পরে তাঁরা কেউই ব্রিটিশদের হাতে ধরা দিতে চাননি। রাইটার্সের অলিন্দে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধের পরে ধরা দেবেন না বলে বাদল গুপ্ত আত্মঘাতী হন পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে। বিনয় এবং দীনেশ নিজেদের বন্দুক থেকে নিজেদের গুলি করেন। হাসপাতালে কিছু দিন মরণপণ যুদ্ধের পরে ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় বিনয়ের।
১৬২০
দিনেশের জন্য আদালতে মৃত্যুদণ্ড ধার্য হয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই আলিপুর জেলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অগ্নিযুগে মহাকরণের অলিন্দযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। স্বাধীনতা লাভের পরে গোটা ডালহৌসি চত্বরের নামকরণ করা হয় বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ, সংক্ষেপে বিবাদী বাগ।
১৭২০
বিনয়-বাদল-দীনেশ এবং আরও অসংখ্য সংগ্রামীর আত্মত্যাগের ফলে পাওয়া স্বাধীনতার পরে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পোশাকি পরিচয় হয় মহাকরণ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য এবং গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের কার্যালয় হয়ে ওঠে শতাব্দীপ্রাচীন এই ভবনই।
১৮২০
২০১৩ সালের অক্টোবরে শুরু হয় মহাকরণের দীর্ঘকালব্যাপী সংস্কার পর্ব। মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়-সহ সব দফতর স্থানান্তরিত হয় হাওড়ার ‘নবান্ন’ ভবনে। স্থানান্তরের আগে পর্যন্ত এই ভবনে রাজ্য সরকারের ৩৪টি দফতর ছিল। সব মিলিয়ে কর্মরত ছিলেন প্রায় ৬ হাজার কর্মী। তাঁরা স্থানান্তরিত হন নতুন কার্যালয় নবান্নে।
১৯২০
৫ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গফুট এলাকার উপর বিস্তৃত মহাকরণকে মনে করা হয় একটি দুর্গের মতোই। যার ভিতরে ধরে যেতে পারে নাগরিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য-সহ ছোটখাটো একটি শহর।
২০২০
স্বাধীনতার পরেও বহু প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের সাক্ষী এই প্রাচীন ভবন। কুর্সির লড়াই এখন যতই নীলবাড়িকে ঘিরে হোক না কেন, লাল ইটের তৈরি করণিকদের আদি কার্যালয়ের গরিমা অমলিন প্রায় আড়াই শতক পেরিয়ে এসেও।