প্রতীকী ছবি।
রাতে খেতে বসে ছেলের ঘোষণা, বন্ধুর সঙ্গে থাকতে চেয়ে বাড়ি ছাড়তে চান। শুনে মরিয়া বাবা বলছেন, ‘‘ডাক্তার দেখাও! দরকার হলে কাউন্সেলিং করো। দেখবে, স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা হয়তো ততটাও শক্ত নয়।’’ আর পুরুষ শরীরে আটকে থাকা নারীসত্তাকে স্বীকৃতি দিতে চেয়ে রূপান্তরকামী ছেলের দৃপ্ত উত্তর, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য অস্ত্রোপচার করাতে চলেছেন তিনি। খাবার টেবিলে তখন শ্মশানের স্তব্ধতা।
‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিতে রূপান্তরকামী চরিত্রে ঋতুপর্ণ ঘোষের এই দৃশ্যায়ন প্রায় সব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরই কঠোর বাস্তব। বয়ঃসন্ধিতে যখন শরীর এবং মননের দ্বৈত সত্তার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন তাঁরা, তখন ঘরে-বাইরে এমনই নানা বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি স্কুল— কোথাওই মন খুলে কথা বলতে পারেন না তাঁরা।
উল্টে বাবা-মায়ের অসহযোগিতা, সন্তানকে বুঝতে না চাওয়ার গোঁড়ামি, সম্পর্ককেও অস্বীকার করার মানসিকতা কখনও কখনও জীবনের বিপজ্জনক বাঁকে এনে দাঁড় করায় তৃতীয় লিঙ্গের ওই মানুষদের। সন্তানের ‘অসুখ’ সারাতে মনোবিদের দ্বারস্থ হওয়া, মারধর এমনকি ধর্ষণের টোটকা, কখনও বা বাড়ি থেকে বিতাড়ন— চেষ্টার কসুর করেন না অভিভাবকেরা। আর গ্রাম-শহর-শহরতলিতে আজও তার খেসারত দিয়ে চলেন রূপান্তরকামীরা। কেউ বাড়ি ছেড়ে পালানোর পথ খোঁজেন, কেউ হন বিপথগামী, কেউ বা ভিন্ রাজ্যে পাচার হয়ে যান। কেউ আবার বেছে নেন আত্মহননের পথ।
কেন সন্তানের তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় মেনে নিতে সমস্যা হয় পরিবারের? পেশায় আইনজীবী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ বলছেন, ‘‘চারপাশটা কেমন, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করে যে, বাবা-মা কী ভাবে ব্যাপারটা নেবেন। আত্মীয়দের মানসিকতাও বাবা-মায়ের উপরে ছাপ ফেলে।’’ রূপান্তরকামী মেঘ সায়ন্তন যখন বাড়িতে জানিয়েছিলেন নিজের পরিচয়ের কথা, মা বীথিকা মেনে নিলেও সহজে মানতে পারেননি বাবা। নাচ শিখতেন বলে আত্মীয়েরাও ‘মেয়েলি’ বলে খোঁচা দিতেন। এমনকি, স্কুলের শৌচাগারে যৌন হেনস্থাও করেছিল সহপাঠীরা। পরিস্থিতি এমন হয় যে, এক সময়ে তিনি ভেবেছিলেন ঘুমের ওষুধ খাবেন।
মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় আবার মনে করছেন, সন্তানকে ঘিরে আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হওয়ার হতাশা এবং সমাজের চিন্তা— মূলত এই কারণেই অবুঝ হয়ে যান বাবা-মায়েরা। রিমার কথায়, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গ যে আলাদা পরিচয়, সেই সত্যিটা এখনও অনেকে সহজ ভাবে নিতে পারেন না। অনেকে মুখে মেনে নিলেও ক্ষীণ আশা রাখেন যে, হয়তো ওই সন্তান এক দিন ‘ঠিক’ হয়ে যাবে।’’ ঘরে-বাইরে এ ভাবেই লড়তে লড়তে তাই অবসাদ গ্রাস করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলিকে। অনেকেই হয়ে ওঠেন আত্মহত্যাপ্রবণ।
হেরে না গিয়ে লড়াই করতে তাই নবীন প্রজন্মকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন মেঘ সায়ন্তন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই আমার কাছে নাচ শিখতে আসে, যারা নিজেদের পরিচয় বুঝতে শিখছে। তাদের পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলি। তা হলে লোকে কী ভাববে, পরিবারের সেই চিন্তাটা কমবে। আর তাদের বাবা-মায়েদের বোঝাই, সমাজের কথা না ভেবে সন্তানের কথা ভাবুন।’’
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র মনে করেন, এ ক্ষেত্রে স্কুলের দায়িত্বও কিছু কম নয়। ‘‘শিক্ষকদেরই পড়ুয়াদের বোঝাতে হবে যে, রূপান্তরকামী হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্কুলের পাঠক্রমে এই অংশটাও থাকা উচিত, যাতে ছোট থেকেই তারা এ ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে ওঠে।’’— বলছেন অভিজিৎবাবু।
রাজ্যের রূপান্তরকামী উন্নয়ন বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য রঞ্জিতা সিংহ আবার মনে করেন, ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের নালসা রায় এবং ২০১৮ সালে ৩৭৭ ধারার বিলুপ্তিকরণের পরেও যে পরিবার-সমাজ অন্য ভাবে ভাবতে পারছে না, তার কারণ সরকারি নিয়মকানুন। রঞ্জিতা বলছেন, ‘‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও বা কন্যাশ্রীর মতো সরকারি প্রকল্প যদি থাকে, তাহলে ‘রূপান্তরকামী বাঁচাও’ প্রকল্প কেন হবে না? তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষণ কেন করা হবে না? আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু এখনও সমানাধিকার পাইনি। তাই রূপান্তরকামী সন্তানকে মানতে আজও এত সমস্যা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy