প্রতীকী চিত্র।
ছোট থেকেই ভাল লাগত উর্দু হরফের টান ও বলার ভঙ্গি। তাতে সঙ্গত দেয় একটি হিন্দি গানের ‘জিসকি জ়ুবান উর্দু কি তরাহ্’ অংশটি। মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল সেটি। তখন থেকেই উর্দু শেখার ইচ্ছে থাকলেও ইতিহাসের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অন্বেষা সেনগুপ্তের সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে সম্প্রতি। জেন্ডার স্টাডিজ়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর দেবদত্তা চৌধুরী আবার বর্তমানে মুসলিম পার্সোনাল ল’ নিয়ে কাজ করছেন। সেই আইনের খুঁটিনাটি বুঝতে সুবিধা হবে, সেই ভেবে আরবি শিখছেন তিনি।
কলকাতা শহরের পাড়ায় পাড়ায় যোগাযোগ বাড়ানোর একটি সংগঠনের উদ্যোগে চালু হওয়া আরবি, ফারসি, উর্দুর ক্লাসে বর্তমানে রয়েছেন প্রায় ১০০ জন পড়ুয়া। ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সামনে খুলে যাচ্ছে সংস্কৃতির অন্য একটি জগতের দরজাও। ‘নো ইওর নেবার’ নামে ওই সংগঠনের তরফে সাবির আহমেদ জানাচ্ছেন, কলকাতার বিশেষ কিছু এলাকার নির্দিষ্ট পরিচিতি তৈরি হয়েছে। সহ-নাগরিকেরা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। সেই ভাবনার মধ্যে পড়ে যায় ভাষা নিয়ে ভুল ধারণাও। অনেকেই ভাবেন, উর্দু, আরবি, ফারসি কেবল মুসলিমদের ভাষা। অথচ, তাঁদের ক্লাসের পড়ুয়াদের মধ্যে বেশির ভাগই অ-মুসলিম। দেশের নানা জায়গা থেকে, এমনকি, বিদেশ থেকেও ক্লাস করছেন কেউ কেউ। কেউ শুধুই নতুন ভাষা শেখায় আগ্রহী। কেউ বা ইতিহাস বা ধর্মতত্ত্বের অনুষঙ্গ হিসেবে ভাষা শিখতে চাইছেন।
ইলাহাবাদ হাই কোর্টের একটি মামলায় বিচারপতি অশ্বিনীকুমার মিশ্র সম্প্রতি মত দিয়েছেন, কোনও ভাষার সঙ্গে কোনও বিশেষ ধর্মকে যুক্ত করা অনুচিত। এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যা কম হওয়ায় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত একটি স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয় এক উর্দু শিক্ষককে। তাঁর দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি মিশ্র জানান, তথ্যপ্রমাণ দেখে প্রাথমিক ভাবে কোর্টের মত, ভাষা হিসেবে উর্দু এমন জায়গাতেও শেখানো যাবে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা কম।
ভাষার সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করার এই গোঁড়ামি অবশ্য নতুন নয়। প্রায় ১০০ বছর আগেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে এম এ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি শিক্ষক-দার্শনিক মহম্মদ শহিদুল্লাহকে। আবার গত বছর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে মুসলিম ধর্মাবলম্বী এক অধ্যাপককে নিযুক্ত করা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়।
ভাষা আর ধর্ম জীবনের দু’টি আলাদা দিক— বলছেন দর্শনের শিক্ষক শামিম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‘নিজের ধর্ম কেউ বদলাতেও পারেন। ধরা যাক, কাল আমি শিন্টো ধর্ম নিলাম। তার মানে তো এই নয় যে, আমি বাংলা ছেড়ে জাপানিতে কথা বলব। পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ছ’-সাতটি ধর্মের মানুষ থাকেন। কিন্তু সেখানে ভাষার ব্যবধান আছে কি?’’ তিনি জানাচ্ছেন, মহাভারত নিয়ে লেখালিখির জন্য তাঁকেও বেশ কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মহাভারতের উপরে পিএইচডি করেছি। বিষয়টা নিয়ে লেখালিখি করাটাই স্বাভাবিক।’’
বাংলা সাহিত্য তো বটেই, প্রতিদিনের বাংলা ভাষাতেও অন্তত দু’-তিন হাজার আরবি, ফারসি শব্দ রয়েছে— জানাচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ইতিহাসের অধ্যাপক অমিত দে। ফারসি ভাষা বাদ দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে
বোঝা যায় না বলেই মত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘ভাষার সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা সারা বিশ্বেই হয়ে থাকে। তাতে রাষ্ট্রের, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা থাকে। কিন্তু সেটা বহুত্ববাদী স্বরকে দমিয়ে রাখার জন্য চাপিয়ে দেওয়া হয়।’’ তাঁর মতে, উর্দু আসলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা। ভারতের অনেক জায়গায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষই উর্দুতে কথা বলেন। তিনি জানাচ্ছেন, ভাষার সঙ্গে ধর্ম জুড়ে দিলে তৈরি হয় সঙ্কীর্ণতা। ধর্মের নামে কোনও ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দিলে বা কোনও ভাষার ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহ করলে অনেক জ্ঞান, ইতিহাস হারিয়ে যাবে। চাপা পড়ে যাবে দেশের সংস্কৃতির নানা দিক।
স্রেফ ভালবেসে উর্দু শিখতে আসা অন্বেষা চান, ধর্মের সঙ্গে ভাষাকে জুড়ে দেওয়ার রাজনীতি, জটিল ইতিহাস নিয়ে চর্চা হোক আরও। জ্ঞানের আলোয় দূরে যাক ভ্রান্ত ধারণা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy