পরীক্ষার খাতা জমা পড়েছে। কিন্তু, তা দেখার জন্য পর্যাপ্ত পরীক্ষক মিলছে না! ডাক্তারি পাঠ্যক্রমে এখন এমনই সমস্যায় রাজ্যের স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি এমবিবিএস পাঠ্যক্রমের কয়েক হাজার খাতা জমা পড়লেও সেগুলি কবে দেখা শেষ হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
অভিযোগ, অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে শিক্ষক-চিকিৎসকদের পরীক্ষক হিসেবে পাঠানো হচ্ছে না। অগত্যা ভরসা করতে হচ্ছে শহরের কয়েকটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের উপরে। খাতা যাতে জমে না থাকে, তার জন্য ওই সব মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেশি সংখ্যায় শিক্ষক-চিকিৎসক পাঠাতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চিকিৎসক মুকুল ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বার বার বলা সত্ত্বেও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পরীক্ষক মিলছে না। সমস্যাটি স্বাস্থ্য দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’’
আর জি কর-আন্দোলনের আবহেই রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও মারাত্মক অভিযোগ ওঠে। জুনিয়র থেকে সিনিয়র চিকিৎসকদের বড় অংশের দাবি, পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এর পরে রাজ্যের তরফে পরীক্ষা ব্যবস্থায় কিছু বদল আনা হয়। পরিবর্তিত সেই ব্যবস্থাপনায় এমবিবিএসের পরীক্ষা হলেও মিলছে না উত্তরপত্র পরীক্ষা করার শিক্ষক-চিকিৎসক।
নতুন ব্যবস্থায় রাজ্যের ৩৮টি মেডিক্যাল কলেজের খাতাই বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রতিটি খাতা কম্পিউটারে আপলোড করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নির্দিষ্ট ঘরে থাকা কম্পিউটারের সামনে বসে সেই খাতা দেখতে হচ্ছে পরীক্ষককে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, খাতা কোন কলেজের কোন পরীক্ষার্থীর, তা জানার বা বোঝার উপায় নেই। কারণ, নতুন ব্যবস্থায় জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের নিয়ম মতো প্রতিটি খাতা কোডিং করা আছে।
সূত্রের খবর, ৩৮টির মধ্যে ১১টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। নিয়মানুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি সমস্ত মেডিক্যাল কলেজেরই পরীক্ষক পাঠানোর কথা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যাঁরা সেখানে এসে খাতা দেখবেন। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পরীক্ষক আসছেন না বলেই অভিযোগ। যার ফলে খাতা জমে থাকছে। যেমন, মাসখানেক আগে এমবিবিএসের দ্বিতীয় প্রফেশনালের প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেন্সিক মেডিসিনের পরীক্ষার পরে প্রায় ২৮ হাজার খাতা জমা পড়েছিল। কিন্তু সপ্তাহখানেক আগেও প্রায় ৮০০-৯০০ খাতা দেখা বাকি ছিল। শেষে এসএসকেএম-সহ শহরের অন্য সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে অতিরিক্ত শিক্ষক-চিকিৎসক পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামলানো হয়েছে। সম্প্রতি এমবিবিএসের তৃতীয় প্রফেশনালের পার্ট ১ এবং পার্ট ২-এর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পার্ট ওয়ানের পাঁচটি বিষয়ে প্রায় ১২ হাজার খাতা দেখা শেষ হয়েছে ঠিকই। সমস্যা বেধেছে পার্ট-২ নিয়ে।
সূত্রের খবর, সপ্তাহ তিনেক আগে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে পার্ট ২-তে শল্য, মেডিসিন, অ্যালায়েড মেডিসিন, স্ত্রী-রোগ, শিশুরোগ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার খাতা জমা পড়েছে। কিন্তু পরীক্ষকের অভাবে এখনও কয়েক হাজার খাতা দেখা বাকি। ফলে রেজ়াল্ট কবে বেরোবে, তা-ও নির্দিষ্ট ভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামলাতে শহরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকদের উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়ছে বলেও জানা যাচ্ছে। নির্দিষ্ট খাতা দেখার পরেও শিক্ষাদান, রোগী পরিষেবা সামলে তাঁদের এখন জমে থাকা খাতা দেখে শেষ করতে হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ১১টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে তেমন ভাবে কোনও পরীক্ষক আসছেন না। কিন্তু কেন? স্বাস্থ্য শিবিরের বড় অংশের অভিযোগ, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষক-চিকিৎসকেরা নামে থাকেন। সপ্তাহের এক-দুই দিন তাঁরা সেখানে যান। বাকি দিনগুলির জন্য মোমের মধ্যে ছাপ দিয়ে নকল আঙুল তৈরি করে বায়োমেট্রিক হাজিরা দেওয়া হয়। তাতে জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের নিয়ম মাফিক সপ্তাহের ছ’দিনই খাতায়কলমে হাজির থাকছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-চিকিৎসক। আর সেই কারণেই ওই সব চিকিৎসককে খাতা দেখতে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না বলেই পর্যবেক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের। পাশাপাশি কোডিং ব্যবস্থা থাকায় পরীক্ষার্থীর পরিচয় জানা সম্ভব না হওয়ায় বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকদের একাংশের খাতা দেখায় অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে বলেও সূত্রের খবর।
সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন, অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্সের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি শুধু ব্যবসা করছে। ডাক্তারির আসনগুলি নিলামে তুলে বিক্রি করছে। নিট-এ যত নীচে র্যাঙ্ক হবে, তত বেশি টাকা দিয়ে পড়তে হবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পড়াশোনা ব্যবস্থার প্রতিও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা থাকা প্রয়োজন। যখন নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তাতে তারা কতটা দায়িত্ব পালন করছে, তা নিয়েও সংশয় থাকছে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)