Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Water Level

জলস্তর নামছেই, পাল্টাবে কি জল-মোহিনী নীতি

পরিস্রুত জল সরবরাহের পরিকাঠামো পুরো তৈরি না হওয়ায় অনেক জায়গায় জল-তোলা হলেও ‘বাধ্য হয়েই’ চোখ বন্ধ রাখে পুরসভা।

সঙ্কট: জলস্তর নামছে। আগামী দিনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শহরে জলের জোগান থাকবে তো? মঙ্গলবার, বৌবাজারে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

সঙ্কট: জলস্তর নামছে। আগামী দিনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শহরে জলের জোগান থাকবে তো? মঙ্গলবার, বৌবাজারে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২০ ০৩:২১
Share: Save:

বলা হয়, রাজনীতিতে নাকি সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সংখ্যার প্রয়োজন হয়।

আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এ-ও বলেন, ‘‘সংখ্যার বিচারে অনেক এগিয়ে থাকলেও জনমোহিনী নীতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি ক্ষমতাসীন দল, এমনটাই সচরাচর ঘটে থাকে।’’

ঠিকই। না হলে ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’-এর (সিজিডব্লুবি) রিপোর্ট আগেই দেখিয়েছিল, ১৯৫৮ সাল থেকে এলাকা বিশেষে কলকাতার জলস্তর গড়ে ৭-১১ মিটার নামছে। যার ফলে পার্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, ফোর্ট উইলিয়াম, রাজাবাজার-সহ একটা বিস্তীর্ণ অংশে ‘পিজোমেট্রিক জ়োন’ তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ শহরের অন্যত্র অবাধে জল তোলার ফলে সেই জায়গাগুলিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, জলস্তরের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পার্ক স্ট্রিট-সহ ওই অঞ্চলস্থিত অ্যাকুইফার থেকে সেই সব জায়গায় জল যাচ্ছে। ফলে পার্ক স্ট্রিট, রাজাবাজারের জলস্তরও ক্রমাগত নামতে শুরু করেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে শহরে জলসঙ্কটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আসন্ন পুর ভোটের আগে সেই আশঙ্কা নিয়েই ফের আলোচনা শুরু হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, ২০১০-এর পরে ২০১৫ সালে ক্ষমতায় এসেও কেন তৃণমূল পুরবোর্ড এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করল না? এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কথায়, ‘‘২০১৫ সালে ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১১৪টিতেই জিতেছিলেন তৃণমূল কাউন্সিলরেরা। পরে সব ক’টি বিরোধী দল থেকে আরও ১০ জন কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেন। ফলে পানীয় জলসঙ্কট দূর করতে নীতি গ্রহণের এটাই তো ছিল উপযুক্ত সময়!’’

কিন্তু ‘জনমোহিনী’ নীতি-ই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

রাষ্ট্রপুঞ্জের (ওয়ার্কিং ডেফিনেশন, ইউএন-ওয়াটার, ২০১৩) ‘জল-নিরাপত্তা’-র (‘ওয়াটার সিকিউরিটি’) সংজ্ঞা অনুযায়ী, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ, পরিস্রুত ও সহজলভ্য পানীয় জলের জোগান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও ‘অনিশ্চিত’ শহরের পানীয় জল-ভবিষ্যৎ। কারণ, শহরের জল সরবরাহের দু’টি উৎস।— গঙ্গার জল এবং ভূগর্ভস্থ জল। সিজিডব্লুবি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, মাটি থেকে জল উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর ১৬টি বরোয় গড়ে ১১-১৬ সেন্টিমিটার জলস্তর নামছে। ১৯৮৬ সালে

ভূগর্ভস্থ জল তোলার পরিমাণ প্রতিদিন ১২ কোটি ১৫ লক্ষ লিটার ছিল। ১৯৯৮-২০০৪ সালে তা বেড়ে ২০ কোটি ৮৭ লক্ষ লিটার হয়েছিল। ২০০৫ সাল থেকে পুরসভা পরিস্রুত জল সরবরাহ করে জল তোলার পরিমাণ কমাতে উদ্যোগী হয়।

ফলে ২০০৬ সালে পুরসভার নিজস্ব নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের পরিমাণ দৈনিক কমে দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৩০ লক্ষ লিটারে। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নলকূপের মাধ্যমে সেই বছর দৈনিক হিসেবে আরও ১৬ কোটি ২০ লক্ষ লিটার জল তোলা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রতিদিনের হিসেবে মোট সাড়ে ৩০ কোটি লিটার জল উত্তোলিত হয়েছিল মাটির নীচ থেকে।

তার পরে কি অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে?

এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অবশ্য বলছে, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, শহরের প্রায় ৪৫ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ৪৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বসবাসকারী সাড়ে তিন লক্ষ মানুষই ভূগর্ভস্থ জলের উপরে নির্ভরশীল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং’ শহরের বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি একটি পরীক্ষা করে। তাতে টানা ৭২ ঘণ্টা ১-২ অশ্ব ক্ষমতাসম্পন্ন (হর্স পাওয়ার) পাম্প চালিয়ে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলির জলস্তর গড়ে ৪-৪.৫ মিটার নেমে গিয়েছে। পাম্প বন্ধ করার পরে পরীক্ষকেরা নেমে যাওয়া জলস্তর আগের অবস্থায় ফিরতে কতটা সময় লাগছে, তা হিসেব করে দেখেছিলেন। পরীক্ষকদের মতে, বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প আরও বেশি ক্ষণ ধরে চালালে জলস্তর ক্ষেত্র বিশেষে ৫-৫.৫ মিটারও নেমে যেতে পারে। এ রকম পরীক্ষার মাধ্যমে জল তোলার ক্ষেত্রে শহরে কত সময় ধরে পাম্প চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে, কত ক্ষমতাবিশিষ্ট পাম্প চালানো হবে প্রভৃতি নিয়ে সার্বিক নীতি করা সম্ভব বলে তাঁরা জানাচ্ছেন। বাস্তবে তা হয়েছে কি?

কলকাতা পুর প্রশাসনের একটি অংশের অবশ্য বক্তব্য, বিল্ডিংয়ের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ জল তোলায় বিধিনিষেধ রয়েছে। তবুও পরিস্রুত জল সরবরাহের পরিকাঠামো পুরো তৈরি না হওয়ায় অনেক জায়গায় জল-তোলা হলেও ‘বাধ্য হয়েই’ চোখ বন্ধ রাখে পুরসভা। কিন্তু জলস্তর নামায় পুরসভার উদ্বেগ ধরা পড়েছে গত ফেব্রুয়ারিতেই জারি করা একটি নির্দেশিকায়। যেখানে পুর কর্তৃপক্ষ ভূগর্ভস্থ জল ‘রিচার্জ’-এর জন্য পার্কগুলিতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরির কথা বলেছেন। আবার গত বছরই বৃষ্টির জল সংরক্ষণে বহুতলে বাধ্যতামূলক ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু এই পরিকল্পনায় এত দেরি হল কেন? যেখানে ২০০৬-’০৭ সালেই সিজিডব্লুবি কৃত্রিম ভাবে ভূগর্ভস্থ জল ‘রিচার্জ’-এর জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে টিউবওয়েল বসানোর পাশাপাশি বৃষ্টির জল সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিল!

এটাও কি সেই ‘জনমোহিনী’ নীতি না কি ‘জল-মোহিনী’ নীতি? প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের।

অন্য বিষয়গুলি:

Water Level Kolkata Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy