ফুটপাত কিনে নিতে গেলে প্রতি বর্গফুটের দর উঠে যায় প্রায় ৭৮ হাজার টাকা। ফাইল ছবি।
কোন বাজার, আর সেখানকার কোন জায়গার ফুটপাত, তার উপরেই নির্ভর করে দর ওঠে! যেমন, গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে ছ’ফুট লম্বা ও তিন ফুট চওড়া ফুটপাতের জায়গা নিতে রোজ ভাড়া গুনতে হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। ওই জায়গাই আবার কিনে নিতে গেলে প্রতি বর্গফুটের দর উঠে যায় প্রায় ৭৮ হাজার টাকা! দু’পক্ষের সই-সহ লেখাপড়া করিয়ে নিতে ‘কোর্ট পেপার’-এর খরচ আরস্থানীয় ‘দাদাদের খুশি’ করার জন্য যা দিতে হয়, তা যোগ করলে এককালীন পড়ে যায় প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা!আবার একটু ভিতরের দিকে এমন জায়গাই পাওয়া যায় দৈনিক ৪০০ টাকা ভাড়া বা ১০ লক্ষ টাকা এককালীন দামে।
কলকাতার ফুটপাত বিক্রি হয়। এমন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু সম্প্রতি ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে শ্যামবাজার এলাকার এক মহিলার অভিযোগ ঘিরে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে ফুটপাতের একটি দোকান কিনলেও সেখানে তাঁকে ব্যবসা করতে দেওয়া হচ্ছে না। বদলে অন্য কেউ সেই দোকান চালাচ্ছেন। তিনি যে ওই জায়গা কিনেছিলেন, তার প্রমাণস্বরূপ কোর্ট পেপারও তুলে ধরেছেন মহিলা। তাতে লেখা, পার্থ দাস নামে এক ব্যক্তি তাঁকে ফুটপাতের জায়গাটি বিক্রি করছেন দেড় লক্ষ টাকায়। দখল করা জমিও তা হলে কোর্ট পেপারে সইসাবুদ করে বিক্রি হয়?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গড়িয়াহাটের মতো একই চিত্র নিউ মার্কেট এবং হাতিবাগানেও। সম্প্রতি এই তিন জায়গাতেই পুরসভার তরফে হকার-সমীক্ষা করা হয়েছে। ফুটপাতের দুই-তৃতীয়াংশ ছেড়ে রেখে হকারদের বসতে বলা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে দ্রুত হকারদের শংসাপত্রও দিয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু ওই সমীক্ষার পরেই গোল বাধে। অভিযোগ, গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট এবং হাতিবাগান চত্বরের ফুটপাতের এমন অবস্থা যে, নিয়ম বলবৎ করতে গেলে বেশ কিছু হকারকে জায়গা ছেড়ে উঠে যেতে হবে। অনেকের দাবি, এতেই নানা অনিয়মের উদাহরণ সামনে আসছে। যাঁরা জায়গা কিনেছেন, তাঁরাই প্রতিবাদ করছেন। সরকারের তরফে বাজার এলাকার হকার নেতাদের উপরে বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরাও হকারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে অভিযোগ। গড়িয়াহাটের এক হকার বলেন, ‘‘নেতারা হকারদের সামলাবেন কী করে? যিনি বিক্রি করছেন আর যিনি কিনছেন, তাঁদের মধ্যে ওই নেতারাই তো মধ্যস্থতা করে টাকা নিয়েছেন। এখন তাঁদের কথা কেউ শুনবেন কেন!’’ সম্প্রতি গড়িয়াহাটের চিত্র দেখতে যাওয়া হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হকার বলেন, ‘‘শ্যামবাজারের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। এখানেও কোর্ট পেপারে সবটা হয়। বেআইনি কাজ আইনি পথে হচ্ছে, এমনটা দেখিয়ে করিয়ে দেওয়ার মতো নির্দিষ্ট লোক ধরা আছে।’’ তাঁর আরও দাবি, দক্ষিণ কলকাতার বড় অংশেই ফুটপাত ব্যবসায় ‘প্যাকেজ সিস্টেম’ চলে। প্যাকেজে স্টলের জন্য লোহার কাঠামো এবং আলো-পাখার বন্দোবস্ত থাকে। এ ছাড়া, প্যাকেজ নিলে বসার টুল এবং টেবিলের জন্য প্রতি মাসে আর ভাড়া দেওয়ার ব্যাপার থাকে না। গড়িয়াহাট, গোলপার্ক ও ভবানীপুরের ফুটপাতে প্রতি বর্গফুট জায়গার ‘দাম’ এখন কার্যত ফ্ল্যাটের দামের থেকেও বেশি।
দরের নিরিখে গড়িয়াহাটকেও ছাপিয়ে যেতে পারে নিউ মার্কেট। সূত্রের খবর, সেখানে সব চেয়েবেশি দর পুরসভা ভবন চত্বরের ফুটপাতের। এর পরেই রয়েছে জওহরলাল নেহরু রোড লাগোয়া ফুটপাত। সেখানে ছ’ফুট বাই চার ফুটের জায়গা বিক্রি হয় ১৬ থেকে ১৭ লক্ষ টাকায়। ন’ফুটের ফুটপাতের দাম ২০ লক্ষেরও বেশি! এক হকার নেতার কথায়, ‘‘নিউ মার্কেটের একটি ঠিকঠাক জায়গায় ফুটপাতের দোকানের ভাড়া দিনে এক হাজার টাকার কাছাকাছি। এই টাকা কত পর্যন্ত যায়, অনেকেই জানেন না।’’
উত্তর কলকাতার হাতিবাগানচত্বর অবশ্য অনেকটাই সস্তা। গড়িয়াহাটে যা প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা, হাতিবাগানে সেটাই পাওয়া যায় ছ’থেকে সাত লক্ষ টাকায়। কেন? এক হকার বললেন, ‘‘নেতাদের রেটের উপরে এটা নির্ভর করে। কোথায়বেশি হবে আর কেন হবে, তাঁরাই বলতে পারেন।’’ কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (হকার পুনর্বাসন কমিটি) দেবাশিস কুমার যদিও বললেন, ‘‘এই বেআইনি কারবার মানা যায় না। প্রশাসনেরই উচিত, দু’পক্ষের কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করে একটা বার্তা দেওয়া।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy