শুভেন্দু অধিকারী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বাংলার রাজনীতিতে দৈনিক ব্যক্তি আক্রমণের নানা নজির তৈরি হচ্ছে। বিধানসভার চলতি অধিবেশনেই এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে শোনা গিয়েছে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু ব্যক্তি আক্রমণের ধারা তো থামছেই না। বরং প্রতি দিন নতুন নতুন পাঁকে পড়ছে। শাসকদল যখন বিরোধী দলনেতা ‘যৌন পছন্দ’ নিয়ে প্রশ্ন তলছে, তখন বিরোধী দলনেতা শাসক শিবিরের শীর্ষনেতার পিতৃপরিচয় নিয়ে লোকসমক্ষে কটূক্তি করছেন! বিভিন্ন দলের নেতারা বলছেন বটে, এই ‘অশ্লীলতা’, ‘কদর্যতা’ এবং ‘ব্যক্তি আক্রমণ’ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সংস্কৃতির বিরোধী। কিন্তু তাতে কিছু থেমে থাকছে না।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত গত সপ্তাহে বিজেপির নবান্ন অভিযানে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে ‘মহিলা’ পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা কাটাকাটির প্রেক্ষিতে। যেখানে শুভেন্দু মহিলা অফিসারকে বলছিলেন, ‘‘ডোন্ট টাচ মাই বডি!’’ ওই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ময়দানে নেমে পড়ে শাসকদল। শুভেন্দুর ‘যৌন পছন্দ’ নিয়ে কটাক্ষ করা শুরু হয়। শাসক শিবিরের অন্যতম শীর্ষনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দুকে ‘পুরুষ পছন্দ-করা নেতা’ বলে প্রকাশ্যেই অভিহিত করেন। আরও এ ধাপ এগিয়ে শাসক তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ শুভেন্দুর নাম না-করেও তাঁকে ‘সমকামী’ এবং ‘বিকৃতি যৌনরুচির’ বলে কটাক্ষ করেন। তৃণমূলের বক্তব্যের মর্মার্থ— যেহেতু শুভেন্দু মহিলাকে তাঁর দেহ স্পর্শ করতে দেননি, তাই তিনি ‘পুরুষ পছন্দ-করা নেতা’। শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘ডোন্ট টাচ মাই বডি’ লেখা পোস্টার পড়ে শুভেন্দুর বাসস্থান কাঁথি শহরে। সেই পোস্টার তৃণমূল মেরেছে, এমন কোনও প্রমাণ বা নথি নেই। কিন্তু তৃণমূল যেহেতু ওই মন্তব্যটি নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমেছিল, তাই অনেকে অনুমান করেছেন, ওই পোস্টার দেওয়ার পিছনে তাদের হাত থাকলেও থাকতে পারে। প্রসঙ্গত, একটি শিশুকে কোলে নিয়ে শুভেন্দুর একটি পুরনো ছবি দিয়েও নেটমাধ্যমে প্রচার শুরু হয়েছে। ওই ছবিতে এক তরুণীও রয়েছেন। তাঁর নমোল্লেখ করেই ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন করা হয়েছে টুইটারে। অনেকের দাবি, ছবিটি এই ভাবে আগেও প্রচার করা হয়েছিল। এখন আবার সামনে আনা হয়েছে।
এর পরেই রবিবার মুখ খুলেছেন শুভেন্দু। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে অভিষেকের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তৃণমূলেরই প্রাক্তন বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন আমলা দীপক ঘোষের লিখিত একটি বইয়ের উল্লেখ করে প্রকাশ্য এক সভায় শুভেন্দু ওই কথা বলেছেন।
এর পরেই সোমবার ওই বিষয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা এবং তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল। তাঁদের বক্তব্য, এটা বাংলার সংস্কৃতি নয়! মন্ত্রী শশী বলেন, ‘‘আমরা যারা রাজনীতি করি, তারা যদি কোনও ব্যক্তিকে আক্রমণ করি, তা হলে আমি মনে করি অন্যরাও অপমানিত হন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন মায়ের সন্তান। তাঁর পিতৃপরিচয় নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন শুভেন্দু অধিকারী, তাতে তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় মিলেছে। এর জবাব শুভেন্দুকেই দিতে হবে!’’ রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের মন্ত্রীর আরও সংযোজন, ‘‘এ সব উক্তি পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। নারীশক্তিকে অপমান করেছেন শুভেন্দু। এক জন মা হিসাবে, এক জন রাজনীতিক হিসাবে আমি শুভেন্দুর মন্তব্যে লজ্জিত!’’
পাশাপাশিই শশী শুভেন্দুকে ‘বিকৃতমনস্ক’ এবং ‘ব্যর্থ রাজনীতিক’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কথায় ‘‘আমি কি ধরে নেব উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন?’’ ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের ভোটগণনা বিতর্কের কথা তুলে শশী বলেন, ‘‘রাজনীতি হবে ইস্যুভিত্তিক। কোনও ব্যক্তি আক্রমণের স্থান নেই সেখানে। সস্তা হাততালির জন্য কোনও রাজনীতিকেরই কুমন্তব্য করা উচিত নয়। বিরোধীদলের উচিত শিষ্টাচার-শিক্ষা নেওয়া!’’
আর কুণাল বলেন, ‘‘শুভেন্দু কেন অভিষেককে এত হিংসা করেন? রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে। কখনও তা তীব্রও হবে। কিন্তু পিতৃপরিচয় তুলে আক্রমণ কেমন রাজনীতি?’’ কুণালের বক্তব্য, অভিষেককে দেখে এখনই পা কাঁপছে শুভেন্দুর। তাঁর কথায়, ‘‘অভিষেক নির্বাচিত সাংসদ। দু’বার জিতেছেন। নিজেকে তৈরি করছেন। শুভেন্দুর থেকে তিনি প্রায় ১৫ বছরের ছোট। এখনই তাঁকে দেখে পা কাঁপছে শুভেন্দুর! এর পরে কী হবে?’’ পাশাপাশিই তৃণমূলের নেতারা জানান, আগামিদিনে অভিষেক এ নিয়ে কী পদক্ষেপ করবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে দল এটা অনুমোদন করে না।
বস্তুত, বাংলার রাজনীতিতে ব্যক্তি আক্রমণ নতুন নয়। বিরোধী রাজনীতিকরা একে অন্যকে আক্রমণ করতে গিয়ে কখনও কখনও এমন কিছু বলে বসেন, যা নিয়ে বিতর্ক হয়। সুদূর অতীতেও তা হয়েছে। কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল তরি-তরকারির সঙ্গে দৈহিক অক্ষমতার সাযুজ্য বা দুর্নীতির প্রশ্নে ‘চোর-ডাকাত’ ইত্যাদি বলার মধ্যেই। কিন্তু কারও যৌন পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে প্রকাশ্যে আক্রমণ আবার তার পাল্টা কারও পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রকাশ্য সভায় কটূক্তি এর আগে এই রাজ্যে ঘটেছে বলে প্রবীণ রাজনীতিকরা মনে করতে পারছেন না। তবে একইসঙ্গে তাঁরা এমনও আশাবাদী হতে পারছেন না যে, এই ধারা এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। তবে তাঁদের আশা, শাসক এবং বিরোধীদল যদি এই ‘ধারা’ বন্ধে সচেষ্ট হয়, তা হলে তাদের সদস্য-সমর্থকেরাও এমন ভাষা ব্যবহারে সংযমী হবেন। প্রসঙ্গত, শাসক তৃণমূল ইতিমধ্যেই বলেছে, এই ‘ধারা’ শেষ হোক। এখন দেখার, বিরোধীপক্ষ তাতে সাড়া দেয় কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy