সমাজ মাধ্যমের ট্রোলিং। প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
নেট-দুনিয়ায় ট্রোলিংয়ের ঘটনায় জড়িতেরা অসামাজিক মানসিকতাসম্পন্ন, স্যাডিস্ট এবং সাইকোপ্যাথ— গবেষণায় এমনটাই দেখা গিয়েছে। তাঁরা যে আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা, এই ভাবনা থেকেই ট্রোলিংয়ের বহু ঘটনা অগ্রাহ্য করার প্রবণতা দেখা যায় নেট-ব্যবহারকারীদের মধ্যে। তবে বর্তমানে কার্যত যে কোনও ঘটনাতেই ট্রোলিং করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শারীরিক গঠন, পোশাক, ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই হোক বা কারও ব্যক্তিগত মতামত, পরামর্শ চাওয়ার পোস্ট— কটু মন্তব্য, পাল্টা মন্তব্য, হুমকিতে দ্রুত ভরে ওঠে কমেন্ট বাক্স। যা দেখে প্রশ্ন ওঠে, শুধু কি অসামাজিক মানসিকতাসম্পন্ন মানুষই ট্রোল করেন? নাকি এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউই? ট্রোলিংয়ের আচরণ কি শুধুই মানসিক গঠনের উপরে নির্ভর করে, না কি পরিস্থিতির সাপেক্ষে যে কেউ দেখা দিতে পারেন ট্রোলার রূপে?
তেমনই অভিজ্ঞতা একটি বহুজাতিক সংস্থার চাকুরে সৌম্য চট্টোপাধ্যায়ের। ফেসবুকে লেখালিখির সূত্রে নানা রকম ট্রোলিংয়ের শিকার সৌম্য জানাচ্ছেন, একটি রাজনৈতিক পোস্টের নীচে তাঁকে কলকাতার বিশেষ একটি রাস্তায় ফেলে মারার হুমকি দিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। সরাসরি ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করায় সৌম্য জানতে পারেন, তিনি লালবাজার এলাকায় একটি দোকানে কাজ করেন। মারধরের হুমকি কেন দিলেন— জানতে চাওয়ায় রীতিমতো লজ্জায় পড়ে যান তিনি। আবার পরিবারকে হুমকি দিয়েছেন, এমন কারও প্রোফাইলে গিয়ে সৌম্য দেখেছেন স্বাভাবিক, মধ্যবিত্ত, ঘরোয়া যাপনের ছবিই। সৌম্য বলেন, ‘‘আসলে যাঁরা এ ভাবে মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন, তাঁরা জানেন যে, আমার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কোনও দিন সামনাসামনি আমি তাঁর থেকে জবাবদিহি চাইতে পারব না। এই যে দূরত্ব, তার জন্যই অভদ্র আচরণ বাড়ে। সামাজিকতা ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা হয় না। এই সুযোগে যে কেউই ট্রোলিং করতে পারেন বলে আমার মনে হয়।’’
নিতান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রোলিংয়ের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পিছনে রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির প্রভাব দেখছেন সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা সুপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, প্রশাসনের একদম উপরের স্তর থেকে অসহিষ্ণুতার জাল বুনে দেওয়া হচ্ছে মানুষের মধ্যে। সামাজিক বহুত্বের ধারণার বদলে জাঁকিয়ে বসছে ‘আমরা-ওরার’ ধারণা। এ সবের জেরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ মেনে চলার প্রবণতা কমছে। কেবলই সংখ্যাগুরুর স্বার্থরক্ষার দিকে প্রশাসনিক নজর থাকায় সামাজিক, ধর্মীয়, লিঙ্গ পরিচয় বা যৌন পরিচয়ের দিক থেকে সংখ্যালঘু বা দুর্বলেরা আরও বেশি করে ট্রোলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। সুপূর্ণা বলছেন, ‘‘ট্রোলিং বাড়তে বাড়তে কার্যত কথোপকথনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ট্রোলিংয়ের জবাবও দেওয়া হচ্ছে ট্রোলিং দিয়েই। সুস্থ, যুক্তিপূর্ণ, গঠনমূলক আলোচনার জায়গাটা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।’’ কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। সুপূর্ণার মতে, এ-ও এক ধরনের ট্রোলিং। তিনি বলেন, ‘‘কোনও বিষয় নিয়ে কেউ হয়তো ২০ বছর কাজ করছেন। তাঁর কোনও কাজ বা মতামতকে নস্যাৎ করার আগে এক শ্রেণির মানুষ বিন্দুমাত্র ভাবেন না। অথচ দেখা যাবে, ওই বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও তাঁদের নেই।’’ এ প্রসঙ্গে তিনি অমর্ত্য সেনকে ট্রোল করার উদাহরণ দিচ্ছেন।
অসহিষ্ণুতার প্রভাব দেখছেন মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ও। কোনও বিষয়ে মতের অমিল থাকলে ভাল ভাবে বোঝানোর চেয়ে হিংসাত্মক ভঙ্গিই বেছে নিচ্ছেন অনেকে। পাশাপাশি, নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি থেকে ‘আমিই শেষ কথা, আমি কাউকে যা খুশি বলতে পারি’-র মতো ধারণা থেকেও ট্রোলিং করেন অনেকে। আবার একটি কুরুচিকর মন্তব্য দেখে অন্যদের মধ্যেও তেমনটা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় বলেও জানাচ্ছেন রিমা। অর্থাৎ, ট্রোলিংয়ের বিষচক্র চলতেই থাকে। রিমা তাই সাবধানবাণী শোনাচ্ছেন, সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মানুষদের সমাজমাধ্যমের বন্ধু তালিকায় স্থান দেওয়া নিয়েও। তাঁর মতে, প্রোফাইল দেখে কারও সম্পর্কে সম্যক ধারণা হওয়া কার্যত অসম্ভব। রিমা বলেন, ‘‘ভুল ধারণা নিয়ে বন্ধুত্ব করে কাউকে ব্যক্তিগত বহু তথ্য জেনে ফেলার সুযোগ আমরা নিজেরাই করে দিচ্ছি। আগে ডায়েরিতে যা লেখা হত, গোপনে রাখা হত, সেটাই এখন সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করে দিচ্ছেন অনেকে। তারই একটা খারাপ প্রভাব হল ট্রোলিংয়ের বাড়বাড়ন্ত।’’
সেপ্টেম্বরে এক শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টও ট্রোলিং নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিচারপতিরাও এর থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। ট্রোলিংয়ের কাঠগড়ায় রোজ বলি হচ্ছেন কেউ না কেউ। বলি দিচ্ছেন তাঁরই সহ-নাগরিকেরা। ট্রোলিংয়ের জেরে ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘নারীবাদী’ বা ‘লিবারাল’-এর মতো শব্দ কার্যত গালাগালিতে পর্যবসিত হয়েছে। আন্তর্জালের কল্যাণে দূরত্ব ঘুচিয়ে আরও পাশাপাশি এসে মত বিনিময়, গঠনমূলক আলোচনার যে পরিসর তৈরি করা যেত, বর্তমানে তা-ই পরিণত হয়েছে বিভীষিকাময় জায়গায়। এই নিরন্তর কাদা ছোড়াছুড়ি কারা করছেন, কেন করছেন, তার পরিণতি কী হচ্ছে— জোরালো হচ্ছে সেই সব প্রশ্ন। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy