ছবি: সংগৃহীত
গত ফেব্রুয়ারিতে লোকসভায় প্রশ্নোত্তর-পর্বে সারা দেশের বিদ্যুৎ চুরির প্রসঙ্গটি উঠে এসেছিল। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছিল, ২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষে বিদ্যুৎ পরিষেবায় ভারতের রাজ্যগুলির সম্মিলিত ভাবে গড় লোকসান হয়েছে ২২.০১ শতাংশ। প্রসঙ্গত, বিদ্যুৎ পরিষেবা দিতে গিয়ে প্রতিটি বণ্টন সংস্থারই প্রযুক্তিগত কিছু ক্ষতির সঙ্গে বাণিজ্যিক লোকসান হয়। যাকে বলে ‘এগ্রিগেট টেকনিক্যাল অ্যান্ড কমার্শিয়াল লস’ বা ‘এটিসি-লস’। আর এই লোকসানের অন্যতম প্রধান কারণই হল বিদ্যুৎ চুরি।
বিদ্যুৎ মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘পাওয়ার ফিনান্স কর্পোরেশন লিমিটেড’-এর রিপোর্ট আবার জানাচ্ছে, ওই অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৩ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। ফলে পরিসংখ্যানেই এ রাজ্যে বিদ্যুৎ চুরির বিষয়টি স্পষ্ট। যার ব্যতিক্রম নয় কলকাতাও। রাজাবাজার, এন্টালি, চিৎপুর-কাশীপুর, তপসিয়া, তিলজলা, একবালপুর, মোমিনপুর, খিদিরপুর, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ-সহ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রমরমিয়ে বিদ্যুৎ চুরি হয়। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তখন বেআইনি সংযোগের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে।
যেমনটা এসেছিল গত মাসে। রাজভবনের নর্থ গেটের সামনে জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় কারণ হিসেবে উঠে এসেছিল বেআইনি ভাবে বাতিস্তম্ভ থেকে বিদ্যুতের তার টানার বিষয়টি। যার পরিপ্রেক্ষিতে শহর জুড়ে বিদ্যুৎ চুরির বিরুদ্ধে অভিযানের কথা ঘোষণা করেছিলেন কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষ। অবশ্য ঘটনাপ্রবাহ বলছে, দুর্ঘটনার পরে বিদ্যুৎ চুরির বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান হবে— পুলিশ-প্রশাসনের তরফে এমন ঘোষণা নতুন নয়। তা হয়ও প্রথম কিছু দিন। কিন্তু দুর্ঘটনার শোরগোল থিতিয়ে গেলে ফিরে আসে পূর্ব পরিস্থিতি।
যদিও বিদ্যুৎ দফতর এবং কলকাতা পুরসভা, কেউই তা মানতে চায়নি। বিদ্যুৎ দফতরের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ২০১৭-’১৮ সালে বিদ্যুৎ চুরি-সহ পরিকাঠামোগত খামতির কারণে ‘এটিসি-লস’ এর পরিমাণ যেখানে ছিল ২৬.৬৯ শতাংশ, সেখানে ২০১৮-’১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। কলকাতা পুরসভার আলো ও বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য মনজর ইকবাল জানাচ্ছেন, রাজভবনের সামনে দুর্ঘটনার পর থেকেই সিইএসসি ও পুলিশের সঙ্গে সমবেত ভাবে বিদ্যুৎ চুরির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘একবালপুর-সহ বহু জায়গায় এফআইআর-ও করা হয়েছে।’’
কিন্তু কেন প্রতি বার কোনও দুর্ঘটনার পরেই অভিযানের কথা উঠে আসে? হুকিংয়ের ‘রেড জ়োন’ কোন অঞ্চলগুলি, তা জানা সত্ত্বেও কেন লাগাতার অভিযান চলে না?— এমন একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকের অভিযোগ, আসলে এর সঙ্গে রাজনীতি জড়িয়ে। স্থানীয় এলাকায় ‘দাদা’-দের নেতৃত্বে এই হুকিং-চক্র চলে। আবার রাজাবাজার, বন্দরের মতো ‘স্পর্শকাতর’ কয়েকটি এলাকায় বেআইনি বিদ্যুৎ সংযোগ কাটতে গেলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যার আশঙ্কাতেও অনেক সময়ে সামগ্রিক অভিযান হয় না।
অথচ বিদ্যুৎ মন্ত্রক সূত্রের খবর, ‘বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩’-এর ১২৬ ধারা এবং ১৩৫-১৪০ ধারা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ চুরি ও বেআইনি বিদ্যুতের ব্যবহার আটকাতে বিশেষ আদালতের মাধ্যমে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করে কড়া পদক্ষেপের সুবিধা রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন, আইন থাকলেও তার প্রণয়ন হচ্ছে কি? রাজস্থানের ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর ‘ফরেন্সিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি’ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর উমেশকুমার চৌধুরী মধ্য ভারতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর বিষয়ে দু’বছর ধরে গবেষণা করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, দেশের মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে তড়িদাহত হয়ে মৃত্যু, বিদ্যুৎ চুরির মতো ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে ভীষণ সাদৃশ্য রয়েছে। বিশেষত কলকাতার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে বিদ্যুৎ চুরির ঘটনা যে কোনও সময়ে বিপদ ডেকে আনে। উমেশবাবুর কথায়, ‘‘বর্ষার তিন মাস অর্থাৎ জুন, জুলাই ও অগস্টে সব চেয়ে বেশি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বেআইনি ভাবে বিদ্যুতের সংযোগ।’’
তাই কখনও শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাজভবনের সামনে জমা জলে, কখনও বন্দর এলাকার জমা জলে বেআইনি বিদ্যুৎ সংযোগের সেই তার আপাত ‘নিরীহ’ ভাবে পড়ে থাকে। কখনও তা অফিস থেকে বাড়ির পথে ফেরা কোনও যুবকের, কখনও আবার অন্য কারও প্রাণ কেড়ে নেয়। আর এ ভাবেই দিন পাল্টায়, বছর পাল্টায়। পাল্টায় না শুধু শহরে বর্ষায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ‘পরম্পরা’! (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy