মায়ের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ শৌভিক শর্মাচৌধুরী। রবিবার, বিরাটির বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
দোতলার ঘরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলে শৌভিক। অনেক সাধ করে নিজের পরিকল্পনায় বারান্দা সংলগ্ন দোতলার এই ঘরটা তৈরি করিয়েছিলেন তাঁর মা। শনিবার রাতে সেই বারান্দা থেকেই মায়ের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন ছেলে। বাড়ির পাশের নির্মীয়মাণ বহুতল থেকে ইটের পাঁচিল তাঁর মায়ের মাথায় যখন ধসে পড়ে, শৌভিক শর্মাচৌধুরী তখন ওই বারান্দায়। ঘটনার পরে তাঁকে বারান্দা থেকে কেউ নামাতে পারেননি।
গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনার রেশ এখনও মেলায়নি। তারই মধ্যে ফের শনিবার রাতে উত্তর দমদম পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের শরৎ বসু রোডের এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে নির্মীয়মাণ বহুতলটির কাছের বাসিন্দা কেয়া শর্মাচৌধুরীর (৫২)। ওই নির্মাণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা এলাকা।
মায়ের মৃত্যুতে একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী শৌভিক। তাঁর সব কিছুতেই ভরসা ছিলেন মা। দিনভর সংবাদমাধ্যম, পাড়ার লোক, পরিচিতদের প্রশ্নের উত্তর দিলেও তাঁর মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। আত্মীয়দের সেই প্রশ্নটি করছেনও শৌভিক। তাঁর জিজ্ঞাস্য, নির্মীয়মাণ বহুতলের পাঁচতলায় কয়েক দিন আগেই তো ইটের গাঁথনি হয়েছে। আচমকা ইট ভেঙে মায়ের মাথাতেই পড়ল? কেউ দেওয়ালে ধাক্কা দেয়নি তো? যদিও এই ধন্দের সত্যতা জানতে পুলিশি তদন্তের অপেক্ষায় রয়েছেন এলাকাবাসী।
শৌভিকের ছোট পিসি শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সংসারের নয়নের মণি ছিলেন কেয়া। তাঁর এমন ভাবে মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দারাও। তাঁদের কথায়, সদাহাস্য, বিনয়ী কেয়াকে তাঁর ব্যবহারের জন্য সকলে খুব পছন্দ করতেন। তাঁর মর্মান্তিক পরিণতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। শৌভিকের আর এক পিসি শুভ্রা গোস্বামী আমেরিকায় থাকেন। টেলিফোনে শুভ্রা বলেন, ‘‘দেশ থেকে সদ্য এসেছিলাম। আবার যাব। শৌভিককে নিয়েই এখন আমাদের চিন্তা। ওই নির্মাণ যেন বন্ধ থাকে। দোষীরা শাস্তি পাক, প্রশাসনের কাছে এটাই আমাদের আর্জি।’’
কেয়ার স্বামী সুদীপ শর্মাচৌধুরী একটি বিমান সংস্থায় কর্মরত। ২৮-২৯ বছরের বিবাহিত জীবন তাঁদের। কেয়ার বন্ধুদের কথায়, ‘‘সুদীপ আর কেয়া একে অপরের জন্য উপযুক্ত। দু’জনকে সব সময়ে একসঙ্গে দেখা যেত।’’ টুটুল আর টুম্পা নামেই অধিক পরিচিত ওই দম্পতি।
কেয়াদের এক আত্মীয় অশোক শর্মাচৌধুরী জানান, শনিবার রাতে সুদীপ বাড়িতে ছিলেন। কেয়া বাড়ির প্যাসেজে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তায় বেরোচ্ছিলেন। গেট খুলে পা বাড়ানোর মুহূর্তেই পাশের নির্মীয়মাণ বহুতলের দেওয়ালের অংশ হুড়মুড়িয়ে পড়ে তাঁর উপরে। লুটিয়ে পড়েন তিনি। শব্দ শুনে বেরিয়ে সুদীপ দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন তিনি। শৌভিক তখন দোতলার বারান্দায়।
অ্যাম্বুল্যান্স না পেয়ে এক আত্মীয়ের গাড়িতে করে কেয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যান সুদীপ এবং পড়শিরা। রবিবার দুপুরে ময়না তদন্তের পরে বিকেলে কেয়ার দেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কিছু সময় তাঁকে রেখে শেষকৃত্যের জন্য নিমতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়ে বাড়িতে যান উত্তর দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান বিধান বিশ্বাস। তিনি জানান, এমন পরিণতির থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ করা হচ্ছে।
সুদীপ বলেন, ‘‘কত বার ওই নির্মাণকারীদের বারণ করেছিলাম, এ ভাবে কাজ না করতে। কখনও সিমেন্ট-বালি, কখনও চাঙড়, ইট খসে পড়ছিল। ওঁদের নিয়ম না মানার ফল ভুগতে হল আমাদের। টুম্পার মৃত্যুর জন্য দায়ী ওরা। কঠিন শাস্তি হোক ওদের।’’ এ দিন নিমতলা শ্মশানে কেয়াকে নিয়ে যাওয়ার সময়ে সুদীপ বলেন, ‘‘ভয় ছেলেটাকে নিয়ে। ও বড্ড মুখচোরা। মায়ের মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছে। দোতলার বারান্দায় ছিল। কত বার নীচে আসতে বললাম। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ওখানে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমি হাসপাতালে গেলাম।’’
কেয়াদের প্রতিবেশী এক বৃদ্ধার প্রশ্ন, ‘‘গোটা পরিবারের হাসি কেড়ে নেওয়া হল। এই বিপর্যয়ের দায় কে নেবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy