গত বছরেও তাঁরা নিজেদের স্কুলের পড়ুয়া এবং অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে বাগ্দেবীর আরাধনায় মেতেছেন। একসঙ্গে প্রতিমা আনা থেকে শুরু করে নিষ্ঠা ভরে পুজো করা, প্রসাদ বিতরণ, খিচুড়ি ভোগ— সব কিছু ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু এ বছরে পরিস্থিতিটা পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে আন্দোলনরত যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের শিক্ষক ও শিক্ষিকারা জানালেন, তাঁরা নিজের নিজের স্কুলে গিয়ে সরস্বতী পুজোয় যোগ দিতেই পারতেন। কিন্তু, যোগ দেননি। তাঁদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাস্তাতেই থাকবেন। তাই ওই শিক্ষক-শিক্ষিকারা ঠিক করেছিলেন, এ বারের সরস্বতী পুজোও তাঁরা করবেন ওয়াই চ্যানেলের ফুটপাতে।
রবিবার ওয়াই চ্যানেলের ফুটপাতে সেই সরস্বতী পুজো আক্ষরিক অর্থেই হয়ে
উঠল সর্বধর্ম সমন্বয়। আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষিকা আজহারউদ্দিন, মেহবুব, রূপা, অনিন্দিতা, সুস্মিতা, নুর আমিনারা এসেছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে। গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে তাঁরা বসে আছেন ওয়াই চ্যানেলে। এক শিক্ষক ধিতীশ মণ্ডল বলেন, ‘‘জানবাজার থেকে প্রতিমা আনা, পুজোর বাজার করেছেন কমলেশ পুরকাইত, উৎপল দাস এবং স্বাগত সাহা। প্রতি বছর ওঁরাই স্কুলের পুজোয় বাজার করা এবং প্রতিমা আনায় উদ্যোগী হতেন। এ বারও তাঁরা সেই কাজ করলেন আমাদের আন্দোলন মঞ্চের পুজোর জন্য।’’
মঞ্চের যেখানে ঠাকুর রাখা হবে, সেখানে আগে থেকেই আলপনা দিয়ে রেখেছিলেন রূপা, নুর, সুস্মিতারা। ওঁরা বলেন, ‘‘আজকের দিনে স্কুলের কথা মনে পড়ছে। বিশেষত, ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে খুব মন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পথে বসে আন্দোলন করা ছাড়া কিছু করার নেই। ২০১৬-এর পুরো প্যানেল বাতিল হয়ে গেলে আমরা পথে বসব। সিবিআই অযোগ্যদের তালিকা দেওয়া সত্ত্বেও কেন যোগ্য-অযোগ্যদের আলাদা করা হচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর যত দিন না পাচ্ছি, তত দিন আন্দোলন চলবে। আজহারউদ্দিনের কথায়, ‘‘আমরা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। সে জন্য আমাদের মঞ্চে একটি প্রতীকী কাঠগড়াও রেখেছি। ছ’-সাত বছর স্কুলে শিক্ষকতা করার পরেও যদি যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে?’’
ধর্না মঞ্চে বসে থাকা শিক্ষকেরা জানালেন, যে পুরোহিত তাঁদের সরস্বতী পুজো করেছেন, তিনি কোনও দক্ষিণা নেননি। এ দিন প্রতিমার এক পাশে ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন হাওড়ার আন্দুলের বাসিন্দা সুদেষ্ণা মাল। তিনি উদয়নারায়ণপুরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা। সুদেষ্ণা বলেন, ‘‘প্রতি বছর ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাই। এ বার ওকে নিয়ে ওয়াই চ্যানেলের পুজোতে এসেছি। নিজের স্কুলে যাইনি বলে একটু মন খারাপ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখানকার অভিজ্ঞতাও ভীষণ ভাল। গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে আমরা একসঙ্গে আছি। হঠাৎ করে সরস্বতী পুজোর দিন তো স্কুলে চলে যেতে পারি না। তাই এখানেই পুজো করলাম।’’
সব আয়োজন করে পুজো শুরু হতে হতে প্রায় বিকেল হয়ে যায়। পুজো শেষে শিক্ষকদের একাংশ জানান, এই অভিশাপের গ্রাস থেকে তাঁদের যাতে দ্রুত মুক্তি মেলে, বিদ্যার দেবীর কাছে সেই প্রার্থনাই করেছেন তাঁরা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)