Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Ambulances

কাঁধে না তুললেও মৃতের সম্মান রাখতে নাজেহাল এ শহরও

এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গের কাছে এক পরিবারের সদস্যদের দেখা গেল, হাওড়া গ্রামীণ এলাকায় যাবেন বলে শববাহী গাড়ি খুঁজছেন। তাঁদের দাবি, কেউ দর হাঁকছেন আট হাজার, কেউ বা ১০ হাজার।

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছে দাঁড়িয়ে শববাহী গাড়ি। শনিবার।

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছে দাঁড়িয়ে শববাহী গাড়ি। শনিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:৪৪
Share: Save:

শববাহী গাড়ি কোথায় পাওয়া যাবে?

নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (এন আর এস) জরুরি বিভাগের প্রবেশপথের কাছে দাঁড়িয়ে, নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে কথা প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটাই করা হয়েছিল। যা শুনে মুহূর্তে তৎপরতা বেড়ে গেল তাঁর। পকেট থেকে মোবাইল বার করে বললেন, ‘‘আমি এই হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। ফোন করে দিচ্ছি, অন্য কারও কাছে যাবেন না, যেমন খুশি টাকা নেবে।’’

এর পরেই ফোনের ও-পারে থাকা ব্যক্তিকে তিনি বললেন, ‘‘দরজার নিরাপত্তারক্ষী আর আমি আছি। সবটা ধরে নিয়ে বুঝে রেট বলিস!’’ ফোনের ও-প্রান্তের কণ্ঠস্বর এর পরে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত মৃতদেহ নিয়ে যেতে দর হাঁকলেন সাত হাজার টাকা! ফোন রেখে প্রশ্ন করা হল— কী ধরে নিতে বললেন? উত্তর নেই। বার বার একই প্রশ্ন করতে এ বার মেজাজ হারালেন ওই ব্যক্তি। সাফ বললেন, ‘‘গাড়ি লাগলে নিন, নয় ছাড়ুন। যেখানেই যাবেন, আমাদের মতো কারও মাধ্যমেই যেতে হবে। সব জায়গায় আমাদের হিসাব ধরে নিয়েই রেট বলা হবে!’’

এটাই কি দস্তুর? গত বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ি সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুল্যান্স বা শববাহী গাড়ির যেমন খুশি হাঁকা ভাড়া দিতে না পারায় এক দিনমজুরের ছেলেকে মায়ের মৃতদেহ কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে হয় বলে অভিযোগ। এর পরেই এ নিয়ে শোরগোল পড়েছে। অনেকেই আঙুল তুলছেন বেসরকারি শববাহী গাড়ির মালিক বা চালকদের জুলুমবাজির দিকে। কলকাতার পরিস্থিতি কী, তা দেখতেই শনিবার ঘুরে দেখা হয় শহরের একাধিক হাসপাতাল চত্বর।

আর তাতেই দেখা গেল, এন আর এসের ওই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। প্রায় সর্বত্রই চলে এক অলিখিত সিন্ডিকেটের হিসাব। ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রতিটি হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, নিরাপত্তারক্ষীরা এই সিন্ডিকেটে জড়িত। এমনকি, যেখান থেকে মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়া হয়, সেখান থেকেও বলা হয়, তাঁদের লোকের থেকেই শববাহী গাড়ি নিতে। আর না নিলে? জুটবে অপমান, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখার ‘শাস্তি’!

এ দিন দুপুরে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন হাসপাতালের এক কর্মী। শববাহী গাড়ি কোথায় পাওয়া যাবে, জানতে চাইতেই তিনি নিজের কাজ ছেড়ে গাড়ির খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কয়েক জন রোগী কোন দিক দিয়ে কোন বিভাগে যাবেন, তাঁর কাছে জানতে চাইলেও সে দিকে তাঁর হুঁশ নেই। ওই কর্মীকে এমনও বলা হল যে, ফোন নম্বর দিয়ে দিলে নিজেরাই কথা বলে নেওয়া যাবে। কিন্তু, তাঁর ভাবখানা এমন যে, গাড়িচালককে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিতে না পারলে যেন তাঁর চাকরি থাকবে না! বললেন, ‘‘আপনাকে একা ছেড়ে দিলে পনেরো-কুড়ি জন ঘিরে নেবে। অ্যাম্বুল্যান্স চালায়, নিজের শববাহী গাড়ি নেই, এমন লোকও এসে ফোন নম্বর দেওয়ার বদলে কমিশন নেবে।’’ শেষে ফোন করে এক চালককে ডেকে এনে বললেন, ‘‘মালিককে বলবি, আমি পাঠিয়েছি। আমি পরে হিসাব বুঝে নেব।’’ সেই চালক যাদবপুর পর্যন্ত যেতে দর হাঁকলেন সাড়ে চার হাজার! শ্মশানের বদলে বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে ছেড়ে দিলে ৫০০ টাকা কম হতে পারে। কিন্তু এত দর কেন? চালকের উত্তর, ‘‘সরাসরি এলে ২৮০০ টাকায় হয়ে যেত। কিন্তু যাঁর মাধ্যমে এসেছেন, তাঁরটা ধরে এই রেট।’’

এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গের কাছে এক পরিবারের সদস্যদের দেখা গেল, হাওড়া গ্রামীণ এলাকায় যাবেন বলে শববাহী গাড়ি খুঁজছেন। তাঁদের দাবি, কেউ দর হাঁকছেন আট হাজার, কেউ বা ১০ হাজার। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘কাঁধে করে তুলে নিয়ে হাঁটলে শোরগোল পড়ে। সসম্মানে মৃতদেহ নিয়ে যেতে প্রতিদিন কত জনকে যে টাকা ধার করে নিয়ে আসতে হয়, সেটা কে দেখে?’’

স্বাস্থ্য দফতরের কারও থেকেই স্পষ্ট উত্তর মিলছে না। বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের মতোই বেসরকারি শববাহী গাড়িও নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে জানিয়ে দিয়েই দায় সারছেন তাঁরা। তবু অ্যাম্বুল্যান্সের ক্ষেত্রে পরামর্শ-বার্তা (অ্যাডভাইজ়রি) জারি করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হলেও শববাহী গাড়ি যে হেতু সরাসরি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সঙ্গে জড়িত নয়, তা এ নিয়ে বিশেষ কিছুই করা যায়নি বলে জানাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।

অন্য বিষয়গুলি:

Ambulances Price Hike dead bodies
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy