স্মৃতিধার্য: আলো দাসের মাধ্যমিকের মার্কশিট নিয়ে মা। শুক্রবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
মাধ্যমিকের ফল ১৯ মে— খবরটা শোনার পর থেকেই অশান্ত হয়ে ছিল মন। দিন যত এগিয়েছে, তাঁর উদ্বেগ ততই বেড়েছে। ১৮ তারিখ রাতটা ঘুমোতে পারেননি। শুধু ভেবেছেন, স্কুলের সামনে গিয়ে কী ভাবে দাঁড়াবেন! কী করে নেবেন মৃত মেয়ের রেজ়াল্ট!
শুক্রবার মহেশতলার সারাঙ্গাবাদ যজ্ঞেশ্বরী পাঠশালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছে কান্না ধরে রাখতে পারেননি কৃষ্ণা দাস। মেয়ে পাশ করেছে শুনে অঝোরে কেঁদে চলেন। কোনও মতে বলেন, ‘‘অনলাইনে খোঁজই নিইনি। যা শোনার স্কুলে এসেই শুনব ভেবেছি। পঞ্চম শ্রেণি থেকে মেয়ে এখানে পড়েছে। প্রতি বার রেজ়াল্টের দিন ওর সঙ্গে স্কুলে আসতাম। এ বার আমি একা। মেয়েটা সঙ্গে নেই ভাবলেই বুকটা হু হু করছে।’’
মহেশতলার পুটখালি মণ্ডলপাড়ায় কৃষ্ণার বাড়ি। গত মার্চে সেখানে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় তিন জনের। মৃতদের মধ্যে ছিলেন কারখানার মালিক ভরত জানার স্ত্রী ও পুত্র। অন্য জন কৃষ্ণার বছর ষোলোর মেয়ে আলো দাস। বিস্ফোরণের শব্দ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা গিয়েছিল। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আলোর দেহ। ঘটনার পরদিন মেলে আলোর একটি হাত। ভরতের দূর সম্পর্কের আত্মীয় আলোদের বাড়ি বিস্ফোরণস্থলের পাশেই। মাধ্যমিকের পরে ছুটির মধ্যে বাড়ির কাছেই বোন প্রিয়ার সঙ্গে খেলছিল সে। তাকে চা-পাতা কিনে আনতে বলেন ভরতের স্ত্রী। আলো চা-পাতা কিনে এনে ঘরে ঢুকে দিতে যাওয়ার সময়েই ঘটে বিস্ফোরণ।
এই সব কথা বলতে বলতে বার বারই কেঁদে ফেলছিলেন কৃষ্ণা। বলছিলেন, ‘‘যা-ই হয়ে যাক, বাড়ির কাছে আর বাজির কারখানা করতে দেব না।’’ তত ক্ষণে স্কুলের চাতালে পাখার নীচে চেয়ারে বসানো হয়েছে তাঁকে। ঘিরে আছেন অন্য পড়ুয়াদের মায়েরা। কেউ হাওয়া করছেন, কেউ চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছেন। স্কুলের দেওয়ালে ঝোলানো আলোর একটি ছবিও নামিয়ে এনেছেন স্কুলের কর্মীরা। কৃষ্ণা বললেন, ‘‘মেয়ে নাচ শিখতে চাইত। বড় হয়ে নৃত্যশিল্পী হবে ভেবেছিল। মেয়ে তো আর নেই, শেষ স্মৃতি হিসাবে রেজ়াল্টটা নিতে এসেছি।’’ তাঁকে আগেই নিজের ঘরে ডেকে পাঠান প্রধান শিক্ষিকা সঙ্ঘমিত্রা মজুমদার। হাতে তুলে দেন আলোর রেজ়াল্ট।
সঙ্ঘমিত্রা জানান, স্কুলটি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। ৮২ জন মাধ্যমিক দিয়েছিল। ১৩ জন অকৃতকার্য। তিন জন প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। সঙ্ঘমিত্রা বলেন, ‘‘প্রান্তিক এলাকার বহু মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। কিন্তু এত খারাপ রেজ়াল্ট কখনও হয় না। লকডাউন ও কথায় কথায় স্কুল বন্ধ থাকায় এই ব্যাচটার খুব ক্ষতি হয়েছে। লকডাউন শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে অনলাইন ক্লাস শুরু হলেও মেয়েদের ক্লাসে আনা যায়নি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘প্রান্তিক এক পরিবারেরই মেয়ে আলো। মোট ১৮৯ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু এখন নম্বরের সব হিসাবের বাইরে সে। যে দিন ওই বিস্ফোরণ হয়, সে দিনই সহকর্মীদের বলেছিলাম, দেখো, খুব খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে। সেই পরিণতি যে আমাদের একটা মেয়ের মৃত্যুর মতো এতটা খারাপ ব্যাপার, কল্পনাও করিনি।’’
পুটখালি মণ্ডলপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাজি বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া বাড়ির পাশেই আলোদের মাটির ঘর। তার বাবা টুটুল গাড়ি চালান। কাজে বেরিয়েছেন। ঠাকুরমা মঞ্জু গিয়েছেন বাড়ির পাশের পুকুরে স্নান করতে। কখন দিদির রেজ়াল্ট নিয়ে মা বাড়ি ফিরবেন, সেই অপেক্ষায় আলোর বোন, অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া প্রিয়া। পাশেই শুয়ে আলোর আদরের পোষ্য ল্যাব্রাডর ‘সুইটি’। প্রিয়া বলল, ‘‘সুইটির মালিক ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল দিদির স্কুলের কাছে। দিদি ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে। সুইটি আছে, দিদিই আর নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy