নাট্যদলের জন্য অনুদান ঘিরে প্রশ্ন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সত্যিই কি বাংলার নাট্যদলগুলিকে ‘বঞ্চিত’ করেছে কেন্দ্র? কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের উল্টে দাবি, বঞ্চনা তো করা হয়ইনি। বরং এ বার বাংলার জন্য বরাদ্দ অনেক বেশি। বলা হচ্ছে, এ বার দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা পাবেন বাংলার নাট্যকর্মীরা। তবুও একাংশের ক্ষোভ নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।
সংস্কৃতি মন্ত্রক সম্প্রতি নতুন অনুদানপ্রাপক নাট্যদলের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় বাংলার ২৯৬টি দলের নাম রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রকের দাবি, তালিকায় কোনও রাজ্যের এত দল নেই। তবে পাশাপাশিই এ বার বাদ তালিকা থেকে গিয়েছে আগে অনুদান পেত এমন ১০টি দল। আবার নতুন ১৯টি দলের নাম যুক্ত হয়েছে তালিকায়। কেন্দ্রীয় সরকার নাট্যকর্মীদের অনুদান দেওয়ার ওই তালিকা প্রকাশ করতেই ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে। উঠেছে বঞ্চনার অভিযোগও। ‘বঞ্চিত’ নাট্যদলগুলির কর্ণধারেরা সোমবার সাংবাদিক বৈঠক করে তাঁদের ক্ষোভের কথা জানাবেন বলে স্থির করেছেন।
প্রসঙ্গত, সংস্কৃতি মন্ত্রক আদতে কোনও নাট্যদলকে অনুদান দেয় না। দেওয়া হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রধান এবং বাছাই সদস্যদের। কোন দলের কত জন অনুদান পাবেন, তা ঠিক করে মন্ত্রক। ওই প্রকল্পকে ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা’ অনুদান বলা হয়। শুধু নাটক নয়, গান বা নাচের দলের সদস্যেরাও অনুদান পান। সংস্কৃতি মন্ত্রকের দাবি, এ বার বাংলার ৮০টি দলের অনুদানপ্রাপক সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কমানো হয়েছে ১৪টির। সংস্কৃতি মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার এ বার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনুদান বাড়িয়েছে। এত দিন নাটক বা অন্য সাংস্কৃতিক দলের গুরু (প্রধান) মাসিক ১০ হাজার টাকা পেতেন। সেটা হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। আবার শিষ্যদের (সদস্য) জন্য মাসিক অনুদান ছ’হাজার থেকে বেড়ে ১০ হাজার টাকা হয়েছে।’’
তবে সে সব নিয়ে অভিযোগ নেই। কলকাতার কয়েকটি নামী সংস্থার নাম কেন্দ্রের তালিকায় নেই কেন, তা নিয়েই বিতর্ক। বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার ‘রাজনৈতিক বিদ্বেষ’ থেকে তালিকা তৈরি করেছে বলেও অভিযোগ। সেই অভিযোগ উড়িয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রকের ওই কর্তার বক্তব্য, ‘‘এমন অনেকের আবেদন খারিজ হয়েছে, যাঁরা বিজেপির সমর্থক হিসাবে পরিচিত। আবার অনুমোদন তো বটেই, অনুদানপ্রাপকের সংখ্যা বেড়েছে এমন দলের, যাদের বিরোধী শিবিরের সমর্থক আখ্যা দেওয়া হয়।’’
কী ভাবে ঠিক হয় কারা অনুদান পাবেন?
মন্ত্রকের দাবি, এটা বিচার করে একটি নির্দিষ্ট কমিটি। বিচার করা হয়, কোন দলের নাট্যচর্চার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। এটাও দেখা হয়, কাদের সহায়তার প্রয়োজন আর নেই। সারা বছর কোন দল কেমন কাজ করছে, তার রিপোর্টের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয় সংস্কৃতি মন্ত্রক।
যে সব দলের নির্দেশক ও কর্মীরা এ বার অনুদান পাবে না, রাজ্য অনুযায়ী সেই সব দলের পৃথক তালিকাও প্রকাশ করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রক। প্রতিটি দলের ক্ষেত্রেই অনুদান বাতিলের ‘কারণ’ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান কারণ, দলগুলি এখন ‘স্বাবলম্বী’। তারা অনুদান ছাড়াই নাট্যচর্চা করতে সক্ষম। আবার যাদের অনুদানপ্রাপক সদস্যের সংখ্যা কমানো হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, দলগুলির বর্তমান যা কার্যকলাপ, তাতে এত সংখ্যায় অনুদান ‘যুক্তিযুক্ত’ নয়। সংস্কৃতি মন্ত্রকের আরও দাবি যে, তারা প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলগুলির পরিবর্তে নতুনদের সুযোগ দিতে চায়।
তবে এ সব যুক্তি মানতে নারাজ তালিকা থেকে বাদ-পড়া ‘সংসৃতি’ বা ‘সায়ক’-এর মতো নাট্যগোষ্ঠী। সংসৃতির প্রধান দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘থিয়েটার একটি মাইনরিটি আর্ট। গোটা পৃথিবীতেই তাই থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়। কারণ, যাঁরা শুধুই থিয়েটার করেন, তাঁদের টিকিয়ে রাখতে সরকারি সাহায্য দরকার।’’ প্রতিষ্ঠিত দলকে বাদ দেওয়ার যে দাবি সংস্কৃতি মন্ত্রক করেছে, তা সঠিক নয় বলেও দাবি অনেকের। তাঁদের প্রশ্ন, কলকাতার অনেক প্রতিষ্ঠিত দলই তালিকায় রয়ে গিয়েছে। কয়েকটি প্রায়-বন্ধ দলকে প্রাপকের তালিকায় রাখা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠিতদের বাদ দিয়ে নতুনদের সুযোগ দেওয়ার যুক্তি মানতে নারাজ সায়ক নাট্যদলের প্রধান মেঘনাদ ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা নাটক নিয়ে অনেক লড়াই করে ২০০০ সালের পরে তালিকাভুক্ত হয়েছিলাম। এখন যারা নতুন, তারাও আগে সেই লড়াই করুক! তার পরে সুযোগ পাক।’’ একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভারতের কোনও দলই প্রতিষ্ঠিত নয়। তিনটি কল-শো করে ৪৫ হাজার টাকা লাভ করলে একটি হল শো-য়ে সমান টাকা লোকসান হয়।’’ মেঘনাদের আক্ষেপ, তাঁর দলের সব সদস্যই বেকার হয়ে গেলেন! তাঁর প্রশ্ন: যাঁরা অন্য কিছু না করে শুধুই নাটক নিয়ে থাকেন, তাঁদের আর পাওয়া যাবে কি?
তবে এর উল্টো প্রশ্নও উঠছে। নতুন করে অনুদানের তালিকায় আসা একটি নাট্যদলের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বলেন, ‘‘লড়াইয়ের কথাটা ঠিক। কিন্তু নতুনরা লড়াই করছে না, এটা বলাও ঠিক নয়। মেঘনাদ’দা আমার শ্রদ্ধেয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে আসছে, নাটকের জন্য লড়াই করা ছেলেমেয়ে কি কমে গিয়েছে? টাকা না পেলে নাট্যকর্মী পাওয়া না গেলে নতুনরা কী করে চালায়? অনুদানের জন্য নাটক, না কি নাটকের জন্য অনুদান?’’
খানিকটা একই সুরে শ্যামনগরের নাট্যকর্মী দুলাল বর বলেন, ‘‘বছরের পর বছর একই দলের ১৮-২০ জনকে অনুদান দেওয়ার কোনও মানে হয় না। পরিবর্তন দরকার। অনেকেই মৌরসিপাট্টা মনে করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রক তদন্ত করলে দেখতে পাবে, অনেক গুরুই শিষ্য হিসাবে আত্মীয়স্বজন, বাড়ির পরিচারক, গাড়ির চালকদের নাম দিয়ে রেখেছেন। লাখ-লাখ টাকায় তাঁরা বিদেশভ্রমণ করেন।’’ বর্তমান তালিকাতেও এমন অনেকে রয়েছেন বলে দাবি দুলালের। আবার নাট্যকর্মী সায়ন্তন বসাকের প্রশ্ন, ‘‘নাটক কি উজালা গ্যাস নাকি! সরকার সাধারণ মানুষের করের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে যাবে কেন? আদৌ এই অনুদান থাকা উচিত কি না, সেটাই ভাবা দরকার। অনেকে তো অনুদান নিয়ে অন্য কাজও করেন!’’ তাঁর আরও দাবি, নাটক সে ভাবে এখন ‘সামাজিক উন্নতি’ ঘটায় না। অনেক ক্ষেত্রেই নাটকের মাধ্যমে রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করা হয় বা গোটাটাই বিনোদন। সায়ন্তন বলেন, ‘‘নাট্যকর্মীদের টাকা দিলে তো যাঁরা ‘রিল’ বানান, তাঁদেরও অনুদান দিতে হয়! বিনোদনের অন্য মাধ্যমের তুলনায় নাটককে ‘ঈশ্বরের সাধনা’ ভাবার কোনও কারণ আছে? ইদানীং তো কলকাতার বড় দল দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত টিকিটের দাম রাখে।’’
প্রথম সারির যে দলগুলির নাম বাদ গিয়েছে, তাদের অনেকের অভিযোগের আঙুল উঠেছে বিজেপির সাংস্কৃতিক সেলের সদস্য অধিকারী কৌশিকের বিরুদ্ধে। তিনিই নাকি ‘কলকাঠি’ নেড়েছেন। নাট্যকর্মী কৌশিক অবশ্য তা মানতে রাজি নন। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘তা হলে যাঁরা পেয়েছেন, সেই তালিকাও কি আমিই বানিয়েছি?’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘অভিযোগ এবং প্রতিবাদ করাটা সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে আমার মনে হয়, সরকারি অর্থ ব্যবহারের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারেনি বলেই হয়তো সংস্কৃতি মন্ত্রক অনেকের অনুদান বাতিল করেছে।’’
বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য প্রতিবাদী নাট্যব্যক্তিত্বদের পাশে থাকার বার্তাই দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি তো বলেইছি যে, সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলে জানব কাউকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাদ দেওয়া হয়েছে কি না। যদি হয় তবে সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কথাও বলব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy