সহনশীল: ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই লোহার পাত দিয়েই তৈরি টালা ট্যাঙ্কের মেঝে। নিজস্ব চিত্র
একটু বেশি জোরে ঝড়-বৃষ্টি হলেই উপর থেকে কাঠের টুকরো পড়ছিল। সন্দেহ হওয়ায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন পুরকর্তারা। পরিদর্শনের সময়ে ধরা পড়ে পুরো টালা ট্যাঙ্কটি আলগা ভাবে যে সব সেগুন কাঠের পাতের উপরে বসানো রয়েছে, ট্যাঙ্কের মেঝে বেঁকে যাওয়ার কারণে কাঠ ও ট্যাঙ্কের সংযোগস্থল আলগা হয়ে গিয়েছে। ফলে জোরে ঝড় হলেই ওই কাঠের এক একটি টুকরো ভেঙে পড়ছে নীচে।
বিষয়টি সামনে আসার পরেই বিশেষজ্ঞেরা বুঝতে পারেন, টালা ট্যাঙ্ক বর্তমানে যে অবস্থায়, তাতে একটু বেশি গতির ঝড় বা ভূমিকম্প হলে বড়সড় বিপদ ঘটতে পারে। বিশেষ করে কলকাতায় যে ভাবে ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়ছে, তাতে এ বিষয়ে আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি কর্তৃপক্ষ। ১০০ বছরেরও বেশি সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে টালা ট্যাঙ্ক অল্পস্বল্প ‘আহত’ হলেও পুরনো প্রযুক্তির জোরেই এত দিন বড়সড় ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়েছে সে। টালা ট্যাঙ্ক সংস্কারের কাজে কলকাতা পুরসভাকে সাহায্য করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিশেষজ্ঞেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতের বিপর্যয় এড়াতে এবং অন্তত আগামী অর্ধ শতাব্দী ধরে যাতে টালা ট্যাঙ্ককে ভূমিকম্প-নিরোধক করা যায় সেই ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। এ জন্য ‘স্যান্ডউইচ মডেল’ প্রয়োগ করা হচ্ছে ওই ট্যাঙ্ক সংস্কারে। এই মডেলের মাধ্যমে টালা ট্যাঙ্কের নীচের তলার পাতকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। কারণ, একশো বছরের ঝড়-ঝাপটায় সেই পাত কিছুটা হলেও বেঁকে গিয়েছে, যে কারণে ওই সেগুন কাঠের টুকরোগুলি মাঝেমধ্যেই উপর থেকে পড়ছিল।
ওই মডেলে কী করা হচ্ছে?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই মডেলে নীচের বেঁকে যাওয়া ১০ মিলিমিটার পুরু পাতটিকে প্রথমে সোজা করা হচ্ছে। তার পরে তার উপরে তিন ইঞ্চির পুরু কংক্রিটের ঢালাই করা হচ্ছে। কংক্রিটের ওই ঢালাইয়ের উপরে আরও একটি ১০ মিলিমিটার পুরু লোহার পাত বসানো হচ্ছে। এর ফলে পুরো কাঠামোরই ক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভিজ়িটিং প্রফেসর বিশ্বজিৎ সোম বলেন, ‘‘আমরা এই স্যান্ডউইচ মডেল প্রয়োগ করে ট্যাঙ্কের নীচের পাতের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছি। এর ফলে ভূমিকম্প হলে এটি বেঁকে যাওয়ার আশঙ্কা কমবে। সারা বিশ্বেই পুরনো স্টিলের কাঠামো রক্ষার ক্ষেত্রে অন্যান্য পদ্ধতির মতোই এটিও ব্যবহার করা হয়।’’
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এমনিতেই প্রযুক্তির দিক থেকে দেখলে টালা ট্যাঙ্ক একটি বিস্ময়! একে মাটি থেকে ১১০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ওই ট্যাঙ্কটি। ২১৫টি লোহার স্তম্ভের উপরে দাঁড়ানো ট্যাঙ্কটির গভীরতা ২০ ফুট। তার উপরে ৯০ লক্ষ গ্যালন জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাঙ্কটি শুধু আলগা ভাবে সেগুন কাঠের উপরে বসানো রয়েছে। বিশ্বজিৎবাবু জানাচ্ছেন, এ ভাবে যে সেগুন কাঠের ব্যবহার, এটাই অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং ভাবনা। কারণ, কাঠের উপরে পুরো ট্যাঙ্কটি শুধুমাত্র আলগা বসানো রয়েছে। কোনও পেরেক মারা নেই। বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, ‘‘রেলওয়ে ট্র্যাক যেমন কাঠের উপরে বসানো থাকে, সেই অভিজ্ঞতা মনে হয় এখানে কাজে লাগানো হয়েছিল। যাতে ঝড়-বৃষ্টি বা ভূমিকম্প হলেও শুধু এটি কাঁপবে। অর্থাৎ কাঠই ওই কাঁপুনি সহ্য করে নেবে। কিন্তু তা মূল কাঠামোয় কোনও প্রভাব ফেলবে না।’’
কলকাতা পুরসভার খবর, টালা ট্যাঙ্ক সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে দু’বছর আগে। ট্যাঙ্কের ভিতরে যে চারটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে, ক্রমান্বয়ে তার একটি বন্ধ করে কাজ করা হচ্ছে। একটি প্রকোষ্ঠের কাজ ইতিমধ্যেই শেষ। হাওয়ার চাপে ট্যাঙ্কের ভিতরের লোহার দেওয়ালের অনেক জায়গা বেঁকে গিয়েছিল। সেই বাঁকা দেওয়াল সোজা এবং মজবুত করার কাজও ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। এক পুর ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘আশা করছি, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy