উদ্বিগ্ন: তখনও বেঁচে সুজিত অধিকারী। তাঁর পড়ে যাওয়ার খবরে ভেঙে পড়েছেন ঠাকুরমা ও এক পিসি। শনিবার, নেহরু কলোনিতে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
তিনি তখনও কার্নিশে বসে। হাসপাতালের কর্মী থেকে শুরু করে সকলে তাঁকে ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুজিত অধিকারীর কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। এরই মধ্যে হাসপাতালের এক কর্মী নিজের মোবাইল থেকে ভিডিয়ো কলে যোগাযোগ করলেন সুজিতের অশীতিপর ঠাকুরমা শিবানী অধিকারীর সঙ্গে। সেই ফোন সুজিতকে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। নিজের নাতিকে ওই অবস্থায় দেখে উদ্বিগ্ন ঠাকুরমা তাঁকে কার্নিশ থেকে নেমে আসতে পরিত্রাহী কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন। কিন্তু সাড়া দেননি সুজিত। এর কিছু ক্ষণ পরেই ঘটে যায় সেই অঘটন। হাসপাতালের নীচে গিয়ে পড়েন সুজিত।
শনিবার সে কথা বলতে গিয়ে বার বারই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বৃদ্ধা। দক্ষিণ দমদম পুরসভার ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে দক্ষিণদাঁড়ি রোডের নেহরু কলোনিতে পাঁচতলা একটি বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন সুজিত। পরিবার বলতে নিজের আড়াই ও নয় বছরের দু’টি সন্তান, ঠাকুরমা এবং পিসি। ২৫-২৬ দিন আগেই সুজিতের স্ত্রী রিয়া কিডনির অসুখে মারা যান। এক আত্মীয়ের কথায়, ‘‘রিয়ার চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। তা-ও ওকে বাঁচানো যায়নি। সব মিলিয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল সুজিত।’’ তাঁদের চিন্তা, সুজিতের মৃত্যুর পরে তাঁর সন্তান দু’টিকে এখন দেখবে কে?
সুজিত বাতিল জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবসা করতেন। দক্ষিণদাঁড়িতে তাঁর দোকান রয়েছে। ব্যবসা ঠিকঠাক চলছিল বলেই দাবি পরিজনদের। তাঁর বড় পিসি মঞ্জু দাস জানালেন, খুব ছোটবেলাতেই সুজিতের বাবা-মা মারা যান। তার পর থেকে ঠাকুরমার কাছেই বড় হয়েছেন তিনি। ঠাকুরমা বলেন, ‘‘রিয়া মারা যাওয়ার পর থেকেই সুজিত কিছুটা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু কাজকর্ম ঠিকঠাকই করছিল। ভিডিয়ো কলে ওকে বার বার নেমে যেতে বললাম। কিন্তু শুনল না।’’
বড় পিসি জানান, মাঝেমাঝেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাতেন সুজিত। গত বুধবারও রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। এর পরে বৃহস্পতিবারও বাড়িতে মাথা ঘুরে পড়ে যান। স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শে মল্লিকবাজারের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। এ দিন সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। তাঁকে আনতেই ছোটপিসি বাসন্তী অধিকারী প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু তত ক্ষণে হাসপাতালের শয্যা ছেড়ে সুজিত কার্নিশে গিয়ে বসে পড়েছেন। আশপাশের সকলের বারংবার অনুরোধেও কান দেননি।
ছোট পিসিও তাঁকে বার বার কার্নিশ থেকে ঘরে যেতে বলেন। তাতেও লাভ হয়নি। এর পরে সুজিতের বড় ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন আত্মীয়েরা। যাতে ছেলেকে দেখে নেমে আসেন তিনি। কিন্তু মাঝপথেই জানা যায়, কার্নিশ থেকে নীচে পড়ে গিয়েছেন সুজিত।
এ দিন সকালে এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই টিভিতে ঘটনাটি দেখছিলেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি যে তাঁদের পাড়ারই সুজিত, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেননি। স্থানীয় বাসিন্দা কৌশিক সাহা বললেন, ‘‘সুজিতের ব্যবসা ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু ২৫-২৬ দিন আগে স্ত্রীর মৃত্যুতে খুব ভেঙে পড়েছিল।’’
এ দিন খবর পেয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে পাশে থাকার বার্তা দেন স্থানীয় কাউন্সিলর তথা দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ পার্থ বর্মা। তিনি বলেন, ‘‘কিছু দিন আগেই সুজিতবাবুর স্ত্রী কিডনির অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ওঁকে বাঁচানো যায়নি। এর পরে আজ এই মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা ওঁর পরিবারের পাশে আছি।’’
এ দিন সন্ধ্যায় সুজিতের বাড়ির সামনে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড়। ঘরের ভিতরে ছোট ছেলেকে সামলাচ্ছেন আত্মীয়েরা। জানলার পাশে বসা ঠাকুরমা শোকে স্তব্ধ। সুজিত বেঁচে যেতে পারেন বলে যেটুকু আশা ছিল, তত ক্ষণে তা-ও শেষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy