হাহাকার: একে একে আসছেন মৃতদের পরিজনেরা। সোমবার রাতে, এসএসকেএমে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
‘‘অফিস চার তলায়। আগুন তো লেগেছিল ১৪ তলায়। তা হলে ভাই নিশ্চয়ই কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে!’’
সোমবার রাতে এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বার বার এই কথাটাই বলছিলেন রেলের ডেপুটি সিসিএম পার্থসারথি মণ্ডলের বোন সুনন্দাদেবী। সন্ধ্যায় আগুন লাগার সময়ে স্ট্র্যান্ড রোডে পূর্ব রেলের নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিংয়ের ভিতরে থাকা ওই প্রৌঢ়ের দেহ তখনও শনাক্ত হয়নি। ‘‘দাউ দাউ করে যখন ১৪ তলা জ্বলছে, তখন বার বার ওঁর মোবাইলে ফোন করেও পাচ্ছিলাম না’’— বলছিলেন পার্থবাবুর গাড়ির চালক সোমনাথ।
‘‘কী ভাবে এমনটা ঘটল’’— পরিজনেদের এই প্রশ্নে ক্রমশ ভারাক্রান্ত হচ্ছিল ট্রমা কেয়ার চত্বর। মাঝেমধ্যেই দ্রুত গতিতে এসে পৌঁছনো অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের আওয়াজে কিছু ক্ষণের জন্য চাপা পড়ছিল সেই প্রশ্ন। পরিজনেরা ছুটে গিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু প্লাস্টিকের বড় বস্তায় মোড়া দেহ দেখে সংশয় আরও বাড়ছিল। সেই সময়ে কার্যত অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ আধিকারিকদের। সকলেরই আফশোস, ‘‘এখন শনাক্ত করানো ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে!’’
কিছু যে করার নেই, তা বুঝতে পারছিলেন চিকিৎসকেরাও। তাঁদের একাংশ জানাচ্ছিলেন, দেহগুলি কাঠকয়লার মতো হয়ে গিয়েছে। কারও দেহ সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে, কারও শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একসঙ্গে মিশে গিয়েছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রমা কেয়ারে এসে পৌঁছনো দেহের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত পৌঁছয় প্লাস্টিকে মোড়া ন’টি দেহ। তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন প্রায় সকলের পরিজনেরাও।
কখনও পুলিশকর্মীরা, কখনও দমকলকর্মীরা তাঁদের পৌঁছে দিচ্ছিলেন ট্রমা কেয়ারের ভিতরে। এক তরুণীকে ধরে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন হাসপাতালের এক মহিলা কর্মী। কান্নায় হাসপাতাল চত্বরে লুটিয়ে পড়ছিলেন ওই তরুণী। তাঁর দিকেই এগিয়ে গেলেন সোমনাথবাবু। জানা গেল, তরুণী পার্থসারথিবাবুর একমাত্র মেয়ে পায়েল। শ্বশুরের ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে সন্ধ্যায় দ্রুত স্ট্র্যান্ড রোডে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রৌঢ়ের জামাই অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। কিন্তু তখনও জানতেন না পার্থবাবুরও প্রাণ কেড়েছে আগুন। দেহ শনাক্ত করার পরে অভিজিৎ বলেন, ‘‘কোভিড থেকে সেরে উঠে উনি কাজে যোগ দিয়েছিলেন। আর এক বছর পরেই অবসর নেওয়ার কথা।’’
রাতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল ২৪ বছরের দমকলকর্মী বিমান পুরকায়েতের। তেমনটাই বলছিলেন ওই যুবকের প্রতিবেশীরা। তাঁদেরই এক জন, মহাদেব সর্দার বলেন, ‘‘ওঁর দাদাও দমকলকর্মী। তিনিও ডিউটিতে ছিলেন। তবে স্ট্র্যান্ড রোডের আগুনে যাননি। অনেক জন আটকে রয়েছেন জানতে পেরে বিমানকে ফোন করতে শুরু করি। কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। শেষে হাসপাতালে এসে দেহ শনাক্ত করতে হল।’’
শিয়ালদহ রেল কোয়ার্টার্সের বাসিন্দা সারওয়ান পাণ্ডের প্রতিবেশী সঞ্জয় সিংহেরা বুঝতে পারছিলেন না ওই প্রৌঢ়ের মেয়ে জ্যোতি আর স্ত্রীকে কী ভাবে জানাবেন যে হাসিখুশি মানুষটি আর নেই। তত ক্ষণে খারাপ কিছু হয়েছে আন্দাজ করে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সারওয়ানের স্ত্রী। আর জ্যোতি বার বার জানতে চাইছেন ‘‘বাবা কোথায়?’’ ট্রমা কেয়ারে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন, আর আশা নেই।
রাতেই হাসপাতালে পৌঁছন রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম ও অন্য শীর্ষকর্তারা। আসেন দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুও। ছিলেন এসএসকেএমের অধিকর্তা মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, দমকলের ডিজি জাভেদ শামিম। রাত দু’টো নাগাদ আটটি দেহই শনাক্ত হয়ে যায়। বাকি থাকে একটি। রাতেই যাতে প্রতিটি দেহের ময়না-তদন্ত হয়ে যায়, তার ব্যবস্থা করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দেহ পাঠানো হয় মর্গে। ট্রমা কেয়ারের ভিড় তখন মর্গের সামনে। পর পর এসে দাঁড়াতে থাকে শববাহী গাড়িও।
তখনই এসে হাজির হন বিমানের বাবা সুনীল পুরকায়েত। কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করার পরে মিষ্টির দোকানের কর্মী ওই প্রৌঢ় চিৎকার করে পাড়ার ছেলেদের কাছে অনুনয় করতে থাকেন, ‘‘ওরে তোরা বুঝতে পারছিস না। ছেলেটাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে দে। এখানে ফেলে রেখে সময় নষ্ট করলে ও আর বাঁচবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy