Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Gramophone Repair Shop

দিলজান, প্রেমের সুরে কথা বলে কলের গান

কলের গানের এই যন্ত্রই যেন মহানগরের দুই চরিত্র, দিলজান মহম্মদ ওরফে বাব্বন ও প্রেম গুপ্তকে এক সূত্রে গেঁথেছে। ওঁরা গ্রামোফোনের মিস্ত্রি। ওঁদের আক্ষেপ, সে বাজার আর কোথায়!

Gramophone

রাধাবাজারে নিজের দোকানে গ্রামাফোন সারাইয়ে ব্যস্ত মহম্মদ দিলজান। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

ঐশী চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৩ ০৮:৪৩
Share: Save:

জ্যৈষ্ঠের দুপুরে পুড়ছে মহানগরের রাজপথ। লালবাজারের কাছে রাধাবাজারের মুখে নাগরিক কোণে এক চিলতে দোকানে তিনি থম মেরে বসে। অনতিদূরে, ধর্মতলায় অন্য এক জন পরম মমতায় আদরের যন্ত্রটি ঝাড়পোঁছ করছেন।গ্রামোফোন। কলের গানের এই যন্ত্রই যেন মহানগরের দুই চরিত্র, দিলজান মহম্মদ ওরফে বাব্বন ও প্রেম গুপ্তকে এক সূত্রে গেঁথেছে। ওঁরা গ্রামোফোনের মিস্ত্রি। ওঁদের আক্ষেপ, সে বাজার আর কোথায়!

আক্ষেপের সঙ্গেই থাকে স্মৃতিচারণ। কথা ভাঙেন দিলজান। সালটা ১৯৬৫। বিহারের মোতিহারির বাড়ি ছেড়ে বছর চোদ্দোর দিলজান বন্ধুর সঙ্গে কলকাতায় পাড়ি দেন। কাজের খোঁজে বেরিয়ে আলাপ ‘গুরু’ নন্দবাবুর সঙ্গে। যন্ত্রটি সারাইয়ের কলাকৌশল শিখতে সেখানেই নাড়া বাঁধা। বছর কয়েক কাটিয়ে এই দোকান— আঙুল উঁচিয়ে দেখান সত্তরোর্ধ্ব মানুষটি। বলে চলেন, “৬০টা বছর কেটে গেল। স্ত্রী, তিন মেয়ে, এক ছেলের মুখে ভাত-রুটি তুলে দিয়েছে এই গ্রামোফোন। এটাই তো সব।”

গ্রামোফোনের কলকব্জার সঙ্গে অন্নের সম্পর্ক নিউ মার্কেট চত্বরের বাসিন্দা প্রেমেরও। ১৪ বছর বয়সে গ্রামোফোন সারাই শুরু করেন। নানা জনের সাহচর্য থাকলেও, আদতে তিনি স্বশিক্ষিত, জানান সাদা পাজামা-পঞ্জাবি আর টুপি পরা সত্তরোর্ধ্ব প্রেম। ১৯৬২-তে গ্রামোফোন সারাইয়ের প্রথম দোকান হয় হাওড়ায়। বছর দুয়েক পরে ধর্মতলায় এই দোকানটি খোলেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সদাহাস্য প্রেমের সংসার। এখন তাঁর দোকান জুড়ে কলের গানের যন্ত্রের সঙ্গে রয়েছে, রেকর্ড প্লেয়ার, সিডি, ক্যাসেট, পেনড্রাইভ। কেন? ছায়া নামে প্রেমের মুখে। বলেন, “সময়ের ফের!”

বস্তুত, এই সময়ের আখর দিয়েই গ্রামোফোন ও কলকাতার ইতিহাসটি লেখা। সঙ্গীত গবেষক ও সংগ্রাহক দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর সময় থেকে কলকাতায় কলের গানের পথচলা। নানা ধরনের চোঙা গ্রামোফোনে ব্যবহার হলেও তামার চোঙা ছিল জনপ্রিয়।” সময়ের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের ইতিহাসেও স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গ্রামোফোন ও রেকর্ডের সম্পর্কটি কেমন, তা জানা যায় সন্তোষকুমার দে-র বিবরণ থেকে (‘কবিকণ্ঠ ও কলের গান’)। গ্রামোফোনের এমন স্মৃতি-মেদুরতায় ভাসেন ‘কলের গান’ ছবির চরিত্র চন্দ্রকান্তের অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মনে পড়ে, “কর্মক্ষেত্রের প্রথম উপার্জন থেকে গ্রামোফোন আর দু’টি রেকর্ড কিনেছিলাম।”

কিন্তু সময়ের সঙ্গে কমেছে কলের গান শোনার চল। পাল্লা দিয়ে কমেছে কলের গানের ‘ডাক্তারের’ সংখ্যাও। দিলজান জানাচ্ছেন, একটা সময় ছিল, দিনে কম করে সাত-আট জন গ্রামোফোন সারাতে আসতেন। এখন সংখ্যাটা দু’-তিন জন, তা-ও সপ্তাহে! বলে ওঠেন, “চেয়েছিলাম, ছেলেটাকে কাজটা শেখাব। কিন্তু ভরসা হয়নি। একটাই চাওয়া, আমৃত্যু যেন কাজটা করতে পারি।”

গ্রামোফোন বাজারের নির্মম সত্যিটা টের পেয়েছেন প্রেমও। একটা সময় তাঁর কাছে গ্রামোফোন সারাতে আসতেন হেমন্ত মুখপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্রদের মতো শিল্পীরা। এখনও কেউ কেউ আসেন। তবে সংখ্যাটা বড়ই কম। প্রেম বলেন, “সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে নানা রকম নতুন যন্ত্র রাখি।” তবুও কিছু মায়া থাকে। তাই বোধহয় কথাগুলি বলতে বলতে প্রেমের নজর জুড়ে থাকে হাতের কাছে থাকা একটি গ্রামোফোনেই।

ঠিক তখনই, কানে ব্লুটুথ হোডফোন গোঁজা তরুণী ছন্দ তোলেন আধুনিকতার। সন্ধ্যা নামে। হয়তো তখনই গ্রামোফোন থেকে ভেসে আসে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে— ‘বেদনা কী ভাষায় রে/ মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে।’ এক মুহূর্ত থমকালেন কি ওই তরুণী! দিলজান, প্রেম আর গ্রামোফোন, এমন অনেক অতীতের ও বর্তমানের গল্প বলে!

অন্য বিষয়গুলি:

Gramophone Dharmatala
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE