লোভনীয়: খাবারের পসরা। শনিবার, উল্টোডাঙার ফুটপাতের একটি দোকানে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতার বইমেলা কিংবা ফুটপাতের খাবার শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে বহু বছর ধরেই। এ বার শহরের সংস্কৃতির ওই দুই দিককে আলাদা ভাবে স্বীকৃতি দিল রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। স্বীকৃতি পেল কলকাতার রসগোল্লাও। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘হেরিটেজ মর্যাদা’ দেওয়া না গেলেও শহরের সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক বিবেচনা করে তালিকায় তাদের বিশেষ ‘উল্লেখ’ করা হয়েছে বলে কমিশন সূত্রের খবর।
কমিশনের কর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই স্মৃতিসৌধ, ভবন বা অন্য নির্মাণ অর্থাৎ স্থাপত্যনির্ভর হেরিটেজ গণ্ডির বাইরে অন্য যে সব সংস্কৃতি রয়েছে, সেগুলিকেও হেরিটেজ-স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে কমিশনের অভ্যন্তরে আলোচনা চলছে। ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন অ্যাক্ট, ২০০১’ অনুযায়ী সে সুবিধা নেই। ওই আইনে শুধু নির্মাণকে তার ঐতিহাসিক, স্থাপত্য বা অন্য গুরুত্বের কারণে হেরিটেজ মর্যাদা দেওয়া যায়। কিন্তু ইট-পাথরের স্থাপত্যের বাইরে, শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা উৎসব, রীতি বা শিল্পকলাকে আলাদা স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছিল কমিশন। সেই সূত্র ধরেই কমিশনের তালিকায় ‘উৎসব’ বিভাগে স্থান করেছে দোল, দুর্গাপুজো, মহরম, কালীপুজো, সরস্বতী পুজো, পয়লা বৈশাখ। এমনকি, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও ক্রিসমাসও। আবার শিল্পকলায় জায়গা করে নিয়েছে কাঁথা সেলাই, আলপনার মতো শিল্প।
হেরিটেজ কমিশনের বিশেষ তালিকায় বইমেলা ঠাঁই পাওয়ায় খুশি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতার আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে বইমেলা। কত মানুষ সেখানে যান। বইমেলার প্রচার-প্রসার এই কারণে আরও হওয়া দরকার। কারণ, মানুষ তো প্রায় বইবিমুখ হয়ে পড়েছিল। বইমেলার কল্যাণে তবু বইয়ের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন অনেকে।’’
কলকাতা বিশেষজ্ঞ হরিপদ ভৌমিকের কথায়, ‘‘কলকাতার ফুটপাতের খাবারের ইতিহাস রয়েছে। অতীতে অনেক পড়ুয়াই এখানকার মেসে থাকতেন। সেখানকার খাবার খেয়ে অরুচি হওয়ায় অন্য খাবারের সন্ধান করতেন তাঁরা। এই সূত্রে বহু জায়গায় ফুটপাতের খাবারের চল শুরু হয়। আবার উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রেল স্টেশনগুলিতে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের খাবারের প্রয়োজন হত। তা মেটাতেও রেল স্টেশন সংলগ্ন ফুটপাতগুলিতে খাবারের দোকান শুরু হয়। পরে তা সারা শহরেই আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে।’’
রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘বইমেলা বা ফুটপাতের খাবারের যে জনপ্রিয়তা, তা বাদ দিলে কলকাতা তো আর কলকাতাই থাকে না! সরাসরি হেরিটেজ মর্যাদা দেওয়া না গেলেও শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে যা যা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, এই প্রথম সেগুলির আলাদা ভাবে উল্লেখ শুরু হল। যাতে কলকাতা বলতে প্রথমেই কী মনে আসে, আর বাঁকুড়া বা কোচবিহার বলতে কী বোঝায়, তা সহজেই কেউ বুঝতে পারেন।’’
এই কারণেই, বীরভূম, বাঁকুড়া, কোচবিহার, দার্জিলিং-সহ সব জেলারই বিশেষ বিশেষ খাবার, নৃত্যকলা, শিল্প, উৎসব স্থান পেয়েছে কমিশনের ঐতিহ্যের তালিকায়। যেমন বীরভূমের মোরব্বাকে আলাদা ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনই দার্জিলিঙের চায়ের পাশাপাশি থুকপা, মোমোরও উল্লেখ রয়েছে। আবার বাঁকুড়ার ভাদু পরব, বিষ্ণুপুর মেলা যেমন স্থানীয় উৎসব তালিকায় রয়েছে, তেমনই নদিয়ার বাউল, কীর্তনকে ‘বিশেষ ভাবে’ উল্লেখ করা হয়েছে।
এই তালিকা কমিশনের তরফে সদ্য চালু করা ওয়েবসাইটে প্রদর্শিতও হয়েছে। কমিশনের এক কর্তার কথায়, ‘‘শহরের ঐতিহ্য, ইতিহাসের সঙ্গে যা যা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, সেই সব ছড়িয়ে থাকা সংস্কৃতিকে এই প্রথম একত্রিত করা হল কমিশনের তরফে। কোনও শহর বা জেলাকে জানতে, বুঝতে এই তালিকা সাহায্য করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy