কখনও বাড়ির শৌচালয়ের টাইলসের নীচ থেকে। কখনও কমোডের ভিতর থেকে প্লাস্টিকে মোড়ানো অবস্থায়। কখনও আবার দেওয়াল ভেঙে, সোফার স্পঞ্জ ছিঁড়ে বা ছবির ফ্রেমের আড়ালে থাকা গুপ্ত কুঠুরি থেকে! বস্তা বস্তা টাকা উদ্ধারের এমন উদাহরণ কম নেই। তবে সেই সব অভিযানের অভিজ্ঞতা মনে করতে গিয়ে তদন্তকারীদের কেউই বলতে পারছেন না, কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনায় কবে এই রাজ্যের কোনও মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে!
এসএসসি দুর্নীতি মামলার তদন্তে শুক্রবার ভোর থেকেই রাজ্যের ১৪টি জায়গায় তল্লাশি শুরু করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শুক্রবার তল্লাশি চলাকালীন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তথা বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের নাম পান ইডি কর্তারা। ওই দিন বিকেলেই অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়। সেই তল্লাশিতেই ফ্ল্যাট থেকে মেলে সাড়ে ২২ কোটি টাকা। পাশাপাশি বিপুল বিদেশি মুদ্রা, সোনার গয়না-সহ একাধিক সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে বলেও সূত্রের খবর। এই ঘটনার পরে শনিবার সকালেই গ্রেফতার করা হয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে।
কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের পরে রাজ্যের মন্ত্রীর এই ভাবে গ্রেফতারির পরেই নানা মহলে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। তবে অতীতে এমন ভাবে টাকা উদ্ধারের ঘটনায় রাজ্যের কোনও মন্ত্রীর গ্রেফতারির উদাহরণ মনে করা না গেলেও বস্তাবন্দি নগদ উদ্ধারের একাধিক উদাহরণ রয়েছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে লটারি দুর্নীতির তদন্তে নেমে শিলিগুড়ি এবং কলকাতার একাধিক জায়গায় অভিযান চালিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা। সেই তল্লাশিতেই নগদ ৮০ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছিল বলে জানা যায়। অভিযুক্তের হাজরার ফ্ল্যাট, অফিসের একাধিক আলমারিতে সাজানো ছিল নোটের তাড়া। পরে জানা যায়, অভিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গ এবং তামিলনাড়ুতে ভুয়ো লটারির কারবার চালাতেন। এমনকি, তাঁর এই বেআইনি কারবারের সঙ্গে বিদেশের যোগও পেয়েছিলেন তদন্তকারীরা। ২০১৬ সালের অগস্টে অন্য একটি ঘটনায় বাড়ির শৌচালয়, কমোড, সোফা, এমনকি, মেঝের পাথরের নীচে নগদ লুকিয়ে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি হাওড়ার এক সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের। পুলিশি অভিযানে তাঁর ঘর থেকে উদ্ধার হয় ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও কয়েক লক্ষ টাকার সোনার গয়না-সহ বহু মূল্যের সম্পত্তিরও হদিস পেয়েছিলেন পুলিশ আধিকারিকেরা। পুরসভার এক জন সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের কাছে এত নগদ কোথা থেকে এল, তা ভেবেই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। নজর এড়াতেই কমোডের ভিতরে প্লাস্টিক মুড়িয়ে, সোফার ভিতরে কোটি কোটি টাকা রাখা হয়েছিল বলে জানা যায়। উদ্ধারের পরে বস্তাবন্দি করে সেই টাকা নিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল পুলিশকে।
বছর দেড়েক আগে, ২০২০-এর নভেম্বরে রাজ্যের এক কয়লা ব্যবসায়ীর বাড়ি ও অফিসে হানা দেয় আয়কর দফতর। তাঁর পুরুলিয়া, আসানসোল, কলকাতার একাধিক অফিসে তল্লাশি চালিয়ে নগদ ৭ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। এ ছাড়া, বিপুল পরিমাণ সোনার গয়না-সহ বেআইনি একাধিক সম্পত্তির হদিস পেয়েছিলেন তদন্তকারীরা। ওই বছরেই অক্টোবর মাসে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ প্রায় দু’কোটি টাকা উদ্ধার করে। এলিয়ট রোডের এক বাড়িতে এত টাকা নগদ কী করে এল, তার সদুত্তর দিতে পারেননি বাড়ির সদস্যেরাও। বছরখানেক আগে, ২০২১-এর ডিসেম্বর মাসে কলকাতা পুরভোটের আগে পার্ক স্ট্রিট এলাকা থেকে নগদ এক কোটি টাকা-সহ এক যুবককে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে হাওয়ালার মাধ্যমে এই টাকা আনা হয়েছিল বলে জানতে পেরেছিলেন তদন্তকারীরা।
ভিন্ রাজ্যে নগদ উদ্ধারের ভূরি ভূরি উদাহরণ থাকলেও জনমানসে সম্ভবত বেশি প্রভাব ফেলেছিল কানপুরের এক ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে নগদ ২৮৪ কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনা। গত বছর ডিসেম্বরের এই ঘটনায়১২০ ঘণ্টা ধরে টানা তল্লাশি চালানোর পরে গ্রেফতার করা হয় ওই ব্যবসায়ীকে। ওই ঘটনার পরে কয়েক মাস যেতে না যেতেই এই রাজ্যেরএক মন্ত্রী ‘ঘনিষ্ঠের’ ফ্ল্যাট থেকে নগদ উদ্ধারের ঘটনা ফের যে জনমানসে প্রভাব ফেলল, তা কার্যত বলার অপেক্ষা রাখে না।