Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
love

আক্রোশের মুখে দাঁড়িয়ে ভালবাসার বিপ্লব

প্রেম আর বিপ্লব তো বরাবরই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যে কোনও দেশে, যে কোনও রাজনৈতিক, উগ্রবাদমুখী অস্থির সময়ে।

আত্মপ্রকাশ: মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘রিজিয়া’ নাটকের পান্ডুলিপির ছবি। সৌজন্যে: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা

আত্মপ্রকাশ: মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘রিজিয়া’ নাটকের পান্ডুলিপির ছবি। সৌজন্যে: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:০০
Share: Save:

‘তালিবানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে চুম্বন করব...’— ফারসি ভাষায় লেখা যে কবিতাকে ২০১৮ সালে আফগানিস্তানের উল্লেখযোগ্য সাতটি সাংস্কৃতিক ঘটনার অন্যতম হিসেবে ধরা হয়েছিল, তার কবি রামিন মাজ়হার।

চব্বিশ বছর বয়সি রামিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার কবিতা শুধুই সেই তালিবানকে নিয়ে নয়, যারা মানুষ হত্যা করে। কারণ তালিবানি হল এক ধরনের মানসিকতা, যা সব ঘরে আপনি পাবেন।’ আর সেই মানসিকতাই দমিয়ে দেয়

বিরোধী কণ্ঠস্বর, নারীর ক্ষমতায়ন। মুক্ত চিন্তা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও বাধা দেয়! এই ‘তালিবানি মানসিকতা’ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায় বলে জানাচ্ছেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সন্দীপ পাণ্ডেও। তাঁর কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে দেশে যাঁরাই বিরোধী তাঁদের ‘গোলি মারো’ বলা হচ্ছে, সেটা-ও তো এক ধরনের ‘তালিবানি মানসিকতা’রই প্রকাশ। যে মানসিকতা সময়-স্থান-মাত্রাভেদে প্রকাশ পায়।’’

যেমন শিক্ষাবিদ ও নাট্যব্যক্তিত্ব আনন্দ লাল তাঁর সদ্য প্রকাশিত একটি বইতে জানাচ্ছেন, ১৮৩১, ১৮৪৯ ও ১৮৭৪ সালে ভারতীয়দের লেখা তিনটি ইংরেজি নাটকে ধর্ম-বিভাজন-বর্ণবিদ্বেষ-বদ্ধ চিন্তার মতো একাধিক বিষয় ছিল। তিনটির একটি নাটক, অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের লেখা ‘কামিনী’-র (১৮৭৪ সাল) মূল চরিত্রে ছিল বছর ষোলোর বিধবা মেয়ে। যার প্রেমে পড়েছিলেন এক জন ব্রিটিশ এবং এক জন বাঙালি পুরুষ। কিন্তু তাঁদের কেউই ‘বিধবা’ কামিনীকে বিয়ে করার সাহস দেখাতে পারেননি।

আবার ১৮৪৯ সালে লেখা ‘রিজিয়া’-র রচয়িতা ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। অসম্পূর্ণ ওই নাটক অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম মহিলা-শাসক রাজ়িয়া সুলতানার জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। আনন্দ লাল বলছিলেন, ‘‘রিজিয়া এক জন আফ্রিকা-বংশোদ্ভূত দাসের প্রেমে পড়েছিলেন। ফলে মাইকেল চাইলেও সেটি মঞ্চস্থ হতে পারেনি। কারণ, মূল চরিত্রে এক জন মুসলিম নারী, বর্ণবিদ্বেষের পাশাপাশি সেই সময়ের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস অগ্রাহ্য করে নারীর প্রেমের উপাখ্যান ধরা হয়েছিল। এই প্রথম সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি সামনে এসেছে।’’

সময়টা ১৯৭৪ সালের নভেম্বর। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’-এর তৎকালীন প্রধান প্রয়াত ইয়াসের আরাফত বলেছিলেন, ‘‘আমার এক হাতে অলিভ গাছের ডাল রয়েছে, অন্য হাতে ধরা রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামীর বন্দুক। আমার হাত থেকে যেন অলিভ গাছের ডালটা পড়ে না যায়!’’ জানিয়েছিলেন, তিনি এমন এক প্যালেস্তাইনের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদিরা কোনও বৈষম্য ছাড়াই বাস করতে পারবেন। সেই ‘সহাবস্থান’ সম্পর্কেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ইমনকল্যাণ লাহিড়ী বলছেন, ‘‘জঙ্গিরা যাতে এ দেশে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তা দেখার পাশাপাশি এ-ও দেখতে হবে ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে যেন জাতীয়তাবোধ তৈরি হয়।’’

রামিন মাজ়হারের কবিতা সম্পর্কে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার অব পার্সিয়ান অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজ়’-এর অধ্যাপক সৈয়দ আখতার হুসেন আবার বলছেন, ‘‘তালিবানি শাসনের মধ্যেও আমরা ভালবাসব, স্বপ্ন দেখব, ভরসা রাখব, এই ঘোষণা করছেন রামিন।’’ এক সাক্ষাৎকারে রামিন যখন বলেন, ‘‘আমার প্রেমিকা এমন এক জন, যখন তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন তখন হয়তো তাঁর ভাইকে হত্যা করা হচ্ছে বা আত্মঘাতী হামলায় তাঁর পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।’’ তখন কোথাও যেন পোশাক দেখে ‘দেশদ্রোহী’ চিহ্নিতকরণ, ‘দেশ কে গদ্দারো কো/ গোলি মারো শালে কো’ বা শাহিন বাগে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর যাবতীয় আস্ফালন, রক্তচক্ষু, বিদ্বেষদীর্ণ এ দেশের পরিস্থিতি এক হয়ে যায়। যেমন ভাবে এক হয়ে যায় যাবতীয় আক্রোশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও ‘এ দেশ আমার’ বলার এই প্রতিস্পর্ধাটুকু।

ফলে ‘তালিবানি মানসিকতা’ যেমন রয়েছে, তেমনই সমাজের চলতি রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে প্রেম-ভালবাসা, সহাবস্থানের মানসিকতাও রয়েছে। সেই প্রেম-ভালবাসা আলাদা মাত্রা বা সংজ্ঞা পাচ্ছে বর্তমান ভারতে। সন্দীপবাবু তাই বলছেন, ‘‘এই যে এত জন মহিলা আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই তো পরিবার পাশে রয়েছে। এটা তো আক্রোশের সামনে দাঁড়িয়ে ভালবাসার বিপ্লব, ভালবাসার প্রতিস্পর্ধাও!’’

অবশ্য প্রেম আর বিপ্লব তো বরাবরই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যে কোনও দেশে, যে কোনও রাজনৈতিক, উগ্রবাদমুখী অস্থির সময়ে। তাই হয়তো দিনের শেষে এক প্রেমিক তালিবানি শাসনের মধ্যে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে প্রেমিকাকে চুম্বনের কথা বলেন, তেমনই হয়তো প্রত্যেক অনিমেষ বুঝতে পারেন,—

‘...বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা’!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy