শোভন চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
মাঝে মাঝে অন্ধকারে হাতড়াই আর ভাবি, এঁরা করছেন কী? নতুন কোনও কাজ তো নেই-ই, উল্টে আমি মেয়র থাকাকালীন হাতে নেওয়া কাজগুলোও শেষ হল না।
নির্বাচনী ইস্তাহারেও কাজের চেয়ে অকাজের কথাই বেশি। শুধু গালভরা গল্প আছে, বাস্তব নেই।
যে কোনও ক্ষমতাসীন দলই নির্বাচনে যায় তাদের কাজের সাফল্য তুলে ধরে। কিন্তু যেখানে যেটুকু বলা হচ্ছে, তা তো আমারই সাফল্য। ৪৩ বছর রাজনীতিতে কেটেছে। ১৯৮৫ থেকে এ পর্যন্ত যে ক’টা পুরভোট হয়েছে, প্রতিটিতেই আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। ১৩২ নম্বরে ২৫ বছর এবং ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ বছর কাউন্সিলর ছিলাম। ন’বছর বরো কমিটির চেয়ারম্যান, পাঁচ বছর মেয়র পারিষদ ও সাড়ে আট বছরেরও বেশি সময় মেয়র থেকেছি। আমি রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে কলকাতার মেয়র হয়েছি। মানুষের কী বক্তব্য,নাগরিকদের কী স্বপ্ন, তাঁরা কী কী পরিষেবা চান— সবটাই জানি। কিন্তু পরে যিনি মেয়র হলেন, তিনি বুঝতে বুঝতেই ভোটের সময় পেরিয়ে গেল! ঘটা করে ‘টক টু মেয়র’ চালু হল। মানুষের মনের কথা শোনা হল কই?
২০১০ সালে মেয়র হই আমি। তখনও শহরের রাস্তায় নাকে রুমাল দিয়েহাঁটতে হত। যত্রতত্র জঞ্জালের স্তূপ। কলকাতায় কম্প্যাক্টর যন্ত্র নিয়ে আসা আমার সময়ের বড় সাফল্য। আমাকে বলা হয়েছিল, কলকাতাকে জঞ্জালমুক্ত করতে হবে। আমি করে দেখিয়েছি। জল সরবরাহ
ব্যবস্থাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গিয়েছি, সেটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন গার্ডেনরিচের জলধারণ ক্ষমতা ছিল মাত্র ৩৭ মিলিয়ন গ্যালন। আজ তা ১৮৫ মিলিয়ন। তখনকার সব চেয়ে বড় জল প্রকল্প পলতা যতটা জল দিত, এখন গার্ডেনরিচ তা ছুঁয়ে ফেলেছে।
২০২০ সালের মধ্যে সেই ধারণক্ষমতা বেড়ে ২১০ মিলিয়ন গ্যালন হওয়ার কথা ছিল। এ জন্য পুরসভার কোষাগারে ২১৫ কোটি টাকা রাখাও ছিল। কিন্তু ২০২১ শেষ হতে চললেও সেই কাজ হল না কেন, কে উত্তর দেবে? আমি মেয়র হওয়ার আগে মাত্র ৩৫টি পুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল। সেই সংখ্যাটা ১৪০-এর উপরে নিয়ে গিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি করেছি।
কলকাতার অন্য বড় সমস্যা, জমা জল। এখন বৃষ্টি হলেই দেখছি, সকলে নাজেহাল হচ্ছেন। এই সমস্যা মেটাতে আমরা নতুন ভাবে ভেবেছিলাম। সিঁথির মিল্ক কলোনির মতো একাধিক জায়গায় আগে প্রচুর জল জমত। এক বার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখান থেকে জল পাঠিয়ে দেওয়া হল দত্তপুকুরের বীরপাড়ায়। সেখান থেকে জল নিয়ে গিয়ে ফেলা হল দমদম খালে।
খালের জল বেড়ে যাওয়ায় দমদম সমস্যায় পড়ছে দেখে লালাবাবু নিকাশি নামে এক জায়গায় জল নিয়ে গিয়ে ফেলা হল। বেহালার জল নিয়ে গিয়ে বেগোর খাল ও বেহালা ফ্লাইং ক্লাবে ফেলার ব্যবস্থা হল। আক্রায় বিশাল একটি পাম্পিং স্টেশন তৈরি করা হয়েছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। কিন্তু এখন সেগুলিতে আর নজরদারি চালানো হয় না। অথচ, লাগাতার নজরদারি চললে নির্দিষ্ট কোনও দিনে ভুগতে হয় না। এর জন্য বিশাল বিজ্ঞ হওয়ারও দরকার নেই। কাজে মন দিলেই চলে। কিন্তু মন দিয়ে যদি কাজ করা হত, ঝড়ের দিনে এই হাল হয়?
বডিগার্ড লাইন্সে কাজের জন্য এডিবি থেকে ২৫ কোটি টাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। ঠিক হয়েছিল, বডিগার্ড লাইন্স থেকে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে টালিনালায় জল ফেলা হবে। মোমিনপুরেও একটি পাম্পিং স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা হয়। কিন্তু আমি মেয়র পদ ছাড়ার তিন বছর পরেও কোনওটাই বাস্তবায়িত হল না। টাকার সমস্যা কিন্তু নেই। পুর কোষাগারে টাকা মজুত ছিল। এখনও পুরসভার কাছে এমন জাদুকাঠি রয়েছে, যা ব্যবহার করে ১৫ দিনে এককালীন দেড় হাজার কোটি টাকা উঠে আসতে পারে। কিন্তু যাঁরা পুরসভা চালাচ্ছেন, তাঁদের কি এ নিয়ে কোনও ধারণা আছে? উল্টে তাঁরা নাকি ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডে আমাকে শিক্ষা দেওয়ার মতো প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। বলতে চাই, সেই প্রার্থীও তো আমারই নাম ভাঙিয়ে জিতছেন।
আসলে আমাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ২০১৭ সালেই একটা বই করে বিধায়ক, সাংসদ, কাউন্সিলরদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল,২০২০-তে ভোট হলে কী কী কাজ নিয়ে মানুষের কাছে ভোট চাওয়া যাবে। তখনও জানতাম, আমিই মেয়র মুখ! এখন দেখলাম, দল ছাড়তেই মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে মুছে ফেলা হচ্ছে। দলের মুখপত্রে এক লেখক মেয়রদের সাফল্য নিয়ে লিখেছেন। সেখানে সুব্রতদা (মুখোপাধ্যায়) আছেন, অথচ আমি বাদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy